photo

বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৩

ময়মনসিংহের একটি বর্ধিষ্ণু জনপদ—মুক্তাগাছা

গৌতমকুমার দাস রত্নগর্ভা ময়মনসিংহ প্রকৃত স্বর্ণখচিত এক জনপদের নাম। ময়মনসিংহ মানে প্রাণের উৎসব, যার যাত্রা কেবলই সামনের দিকে। মহুয়া-মলুয়া-মদিনা-লীলা-চন্দ্রাবতীর এক আদি ও অকৃত্রিম লীলাভূমি ‘‘ময়মনসিংহ গীতিকা’’র সৃজনভূমি ঐতিহ্যের এই পাদপীঠ ময়মনসিংহ। নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং ইতিহাসের বহু সোনালি অধ্যায়ের গৌরবের স্বর্ণচিহ্ন এসবই সমৃদ্ধ করেছে ময়মনসিংহকে। ঐতিহ্যবাহী জনপদ ময়মনসিংহে প্রাচুর্যের চূড়ায় রয়েছে গোলাভরা ধান, গোয়াল-ভর্তি গোরু, পুকুরভরা মাছ, মেঠোসুরের আলাপন, ফসলের গান আর নবান্নের উৎসব। আনন্দ আর উৎসবের মধ্যে বেঁচে থাকা মানুষ তাই ‘Mymensing’-কে নিজেদের মতো করে অর্থ করে নেয়—” আমার লোকেরা গান গায়।’’ বহ্মপুত্র নদ বিধৌত এই ময়মনসিংহের নাম বদল হয়েছিল মোমেন শাহী নামে। মোগল আমলের এক পীর মোমের শাহ-এর নামানুসারে ১৯৪৭-এর পরে এই নামের রদবদল। কিন্তু অতি-প্রাচীন ঐতিহ্যের মহুয়া-মদিনার জনপদ ময়মনসিংহ আবার ফিরে এসেছে সগৌরবে। সাধারণ মানুষের বৌদ্ধিক চেতনায় ঐতিহ্যের জয় হয়েছে। ধোপেও টেকেনি এই পরিবর্তন। ময়মনসিংহের চারদিকে সবুজ শস্য আর বনানীর চাঁদোয়া। এখানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ‌্যালয় চত্বরে গাছগাছালির মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আর তাদের কলকাকলি মাতিয়ে রাখে বিশ্ববিদ‌্যালয়ের পরিবেশ। মহারাজ সূর্যকান্ত আচার্যের বিশালাকার রাজপ্রসাদ দেখে নেওয়া যায়। নিঃসন্তান সূর্যকান্ত তাঁর দত্তকপুত্র শশীকান্তের জন্য একটি সুরম্য প্রাসাদ বানিয়ে দিয়েছিলেন এই ময়মনসিংহে যা শশীলজ নামে খ‌্যাত। এই শশীলজে তখনকার দিনে তিনলক্ষ টাকা খরচ করে প‌্যারিস থেকে একটি সিঁড়ি এনে স্থাদন করেছিলেন শশীকান্ত। ঐ সিঁড়ি দিয়ে ওঠা- নামা করার সময় সুর বেজে উঠতো থেকে থেকে। যে-কেউ এই শশীলজে ঢুকতে পারতো না। এমনকি এই রাজবাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় প্রজাদের মাথা নিচু করে, খালি পায়ে, হাতজোড় করে, মাথা থেকে ছাতা নামিয়ে রেখে চলতে হতো। নিয়মের অন্যথা হলেই শাস্তি পেতে হতো — এমনটাই বললেন অভিজাত বয়স্ক মুরুব্বি, আলহজ্ব মোতিউর রহমান সাহেব। তাঁর বইয়ের দোকান মতি লাইব্রেরির সুনাম ময়মনসিংহ শহরজুড়ে। শহরের পাশ দিয়ে বয়ে-চলা ব্রহ্মপুত্রের স্থিরজলে নৌকাবিহার খুবই আনন্দের। ব্রহ্মপুত্র নদের পাশেই গড়ে উঠেছে শিল্পাচার্য জয়নাল আবেদিনের চিত্রসংগ্রহশালা। ময়মনসিংহ শহরে আরও এক ঐতিহ্যের স্থান আলেকজান্ডা ক্যাসেল। ১৯২৬ সালে ইতিহাসের এক স্বর্ণ অধ্যায়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন এই ময়মনসিংহে এবং আলেকজান্ডা ক্যাসেলে উঠেছিলেন। আলেকজান্ডা ক্যাসেল ইতিহাসের সেই সাক্ষ্যবহন করে চলেছে। গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কাঠের তৈরি বিলাস ভবনটি শহরের মধ্যেই অবস্থিত। চীন দেশ থেকে চীনা কারিগর এনে এই ভবন তৈরি করেছিলেন এই জমিদার। শহর থেকে আধঘণ্টা দূরত্বে ময়মনসিংহের আরও একটি বর্ধিষ্ণু জনপদ—মুক্তাগাছা। এখানেও রাজবাড়ি রয়েছে। আর আছে রাজ-রাজেশ্বরীর মন্দির। মুক্তাগাছায় লোভনীয় মণ্ডার স্বাদ না নিলে, ময়মনসিংহ ঘোরা অপূর্ণ থেকে যায়। প্রয়াত গোপাল পাল প্রতিষ্ঠিত এই মণ্ডার দোকানটি রাজবাড়ির উলটোদিকে। মণ্ডা-প্রতি পনেরো টাকা দরে এখনও দেদার বিক্রি হয়ে চলে। এলাকার লোকেরা বলেন হাওড়, জঙ্গল‍‌ মোষের শিং—এই তিনে মিলে ময়মনসিংহ। এককালে এই ময়মনসিংহের অধীনস্থ ছিল মধুপুরগড়ের জঙ্গল, যা এখন জেলা বিন্যাসের পর টাঙ্গাইল জেলার অন্তর্গত। এই জঙ্গলে একদা আধিপত্য ছিল ‘‘দেবী চৌধুরীরানী’’-এর ডাকাতসর্দার ভবানী পাঠকের। এখন মধুপুর জঙ্গল আয়তনে বেশ ছোট হয়ে গেছে। গাছ কেটে নিয়েছে মানুষ। শাল-সেগুনের এই মধুপুরগড়ের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় বেশ কয়েকটি হরিণ। বাংলাদেশ সরকার এই মধুপুরগড়ের জঙ্গলকে জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা দিয়েছে। ময়মনসিংহে থাকার মতো অনেক আবাসিক, হোটেল রয়েছে। ঢাকা থেকে পর পর ট্রেন ছেড়ে আসে ময়মনসিংহের উদ্দেশে। আর বাস-সার্ভিস পর্যাপ্ত। ময়মনসিংহ ছেড়ে বেরোনোর আগে যে-কোনো বই দোকান থেকে দীনেশচন্দ্র সেনের ‘‘ময়মনসিংহ গীতিকা’’ সংগ্রহ করতে ভুলবেন না যেন। ময়মনসিংহ গীতিকার মহুয়া, মলুয়া, মদিনারা এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে ময়মনসিংহের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের জলে সেই ঐতিহ্য যেন বয়ে চলে মেঘনার বুকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন