পিক্নিক
কৈশোরের শেষাংশ কেটেছে পূর্ব-পাকিস্তানে আর যৌবনের উদ্গম হয়েছে সদ্যস্বাধীন-বাংলাদেশে এবং সুকান্তের ভাষায় ‘জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভুমি...’। ক্ষুব্ধতার বিভিন্নরুপ প্রকাশের মধ্যে এক রুপ ছিল: দম্ মারো দম্, বৈষ্ণবীরুপ জীনাত আমান, খঞ্জনীরুপ কল্কী, প্রায় অজানুলম্বিত জুলফি, পুরুস্ঠু কটিবন্ধনী, বেলবটম ট্রাউজার্স, সুউচ্চ জুতা এবং তালে-বেতালে ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা...’। অন্য রুপ ছিল: খামোখাই বেয়াদপী: ‘মানিনা কো কোনও আইন, ভরা তরী করি ভরাডুবি, ভীম, ভাসমান-মাইন’। সে মাইন-এ ছিন্ন-ভিন্ন হয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান যাকে পাকিস্তানীরা ‘ক্বতল্’ করতে পারে নি, কিন্তু বাঙালীরা খুন করার যুক্তি পেয়েছিল। মনে হয় শেখ মুজিব অন্তিম মুহূর্তে বিশ্বাসই করে উঠতে পারেন নি: তার গায়ে যা লেগেছে তা গুলি, যা বেরুচ্ছে তা রক্ত, এবং যারা তাকে গুলি করলো তারা “আর যদি আমার লোকের উপর হত্যা করা হয়” ঘোষিত ‘আমার লোক’! উনার শেষ মুহূর্তগুলি সম্ভবত অবিশ্বাসের দমকে নিঃশেষিত হয়েছিলো। বিশ্বাসী মানুষ, কিন্তু মউত কবুল করেছেন অবিশ্বাসী হয়ে। মানবীয় বাংলার এ এক দানবীয় রুপ যার পুনঃপৌনিকতা থামানোই যাচ্ছে না! ’৪৭-এর পর থেকে পশ্চিম-পাকিস্তানীরা যে বেয়াদপী করেই যাচ্ছিলো এবং বাঙালীরা প্রত্যুত্তরে তাদের স্বভাবসিদ্ধ-আদব-ভঙ্গ-করে, ’৭১-এ ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর’ চালাতে সক্ষম হোল, ১৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে সেই ‘মুগ্রামী’ অভ্যাসে পরিণত হয়ে অনেক কিছুর মধ্যে এও বলে বসতে বাধ্য হোলো: ‘...ভাত দে হারামজাদা, তা নইলে মানচিত্র খাব...’। এই যৌক্তিক-ক্ষুধাগুলি মেটানোর একটি সমন্বিত পথ আমরা এখনও বের করে উঠতে পারি নি, যা আকারে ও প্রকারে বেড়েই চলেছে, তাই আগের মানচিত্রেও কুলোবে বলে মনে হয় না: তা কি দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর শুষে নেবে নাকি উত্তরে হিমালয় গিলে খাবে তা ক্রমপ্রকাশ্য।
যাহোক, বিশেষত কৈশোরে এবং প্রধানত শীতকালে পিক্নিক বলে একটা চাঞ্চল্য ছিল—কল্পনায়, বাস্তবে, উত্তেজনায়, উন্মাদনায় অনন্য। বিভিন্ন পর্যায়ে অনুমতি মিলবে কিনা সেটা দুরুদুরু, হান্নান সাহেব Bus দেবেন তো? গ্রামোফোনে কি কি গান হবে? সকালে ঘুম ভাঙ্গবে তো! এত সকালে কিভাবে পৌছব? এত শীত কেন? সবাই আসবে তো! শরীফ যদি সিগারেট কিনতে না পারে--তাহলে তো ও একটা ‘শালা’। আচ্ছা, বিদ্যাময়ী স্কুলের ‘ওরা’ নাকি চুনিয়া-কটেজে যাবে! সত্যিই?
ইত্যকার শর্ত মেনে নিয়ে, কল্পনায় মোড়ানো ঘুম হতে জেগেই দেখি, কুয়াশায়-নিড়ানি-দেয়া-সূর্যকিরণ কাটা-ঘুড়ির মত ক্রমশ নতমুখী হয়ে এগিয়ে পাতায় পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুকে আলতো করে জড়িয়ে পতনকে ত্বরান্বিত করছে, আর পতিত বিন্দু শিউলি ফুলের মত টুপ্ টুপ্ করে ঝাপ দিয়ে নীচে ঘাসের উপর জমে থাকা বিন্দুগুলিকে মিলিয়ে বড় বিন্দু হয়ে নীচের ভূমিকে ভিজিয়ে দেবার দুষ্টুমিতে মগ্ন, আর ভুমিও খুব সহজিয়া-অনুরাগে বাইরের ও স্বতঃস্ফুর্ততার সাথে ভেতরের দ্বার খুলে, সমস্ত কোমলতা বিছিয়ে, সেই উষ্ণ-বিন্দুর সাথে স্বেদবিন্দু মিশিয়ে নিষিক্ত হয়ে, অজানা খুশিতে অনামা সৃষ্টিতে মত্ত। এ জন্যই কি কবি লিখেছিলেন: ‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশিরভেজা ঘাসে, সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোঁদে হাসে’। সারা রাতের স্বপন তো অ-নে-ক আর তার বৈচিত্রেরই কি কোনও অগ্রপশ্চাৎ থাকতো? সেটা ছিল স্বপ্ন দেখার ও দেখানোর বয়স... যার রেশ: ‘সেই থেকে শুধু শুধু স্বপ্ন নিয়ে খেলা চলেছে, রাতের আকাশ ভেঙে একরাশ তারা যেন উড়ে চলেছে...’। আর সেই সুব্হে-সাদেকে সৃষ্টি-সুখের-উল্লাস প্রার্থী কেউ যদি রেয়াজ করে... ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়...’ সে সর্বনাশ ঘটাতে কার না মন চাইবে? সে বয়সে ‘সকল’ আর কতটুকুই ছিল কিন্ত ‘সর্বনাশে’ ভেসে যাবার আকুতি ছিল প্রচণ্ড যা চন্বনিয়ে উঠতো ক্ষণপরে আশা’র সেই গান শুনে: ‘কেন সর্বনাশের নেশা ধরিয়ে তুমি এলে না যে, মন লাগে না আর কোনও কাজে...’। এ তো অনুযোগ নয়, রীতিমত একটা চ্যালেঞ্জ! এই ধরনের এক চ্যালেঞ্জ মুকাবিলায় মুখ-দিয়ে-ফিতা-খুলতে-যেয়ে গিট্টু বাঁধিয়ে, এক কিশোর পরবর্তীতে কিশোরী কর্তৃক কটাক্ষিত হতো ‘গিট্টু’ বলে!
সেই কুয়াশা-কাঁদা-ভোরে কোনোমত একটা কিছু মুখে গোজার ভাব করে ‘... রাত্রির ভয় তার চেয়ে ভয়, কখন সূর্য্য উঠে’? দরদে যাদের চোখ কাঁপত, তাদের মধ্যে মা অন্যতম, অপ্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রে মুড়িয়ে “গলা ঢেকে রাখো ও রেখো”, খোদাহাফেজ-মাখা-বরাভয়,অতঃপর ‘...পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা’। বাসা থেকে স্কুল বেশ দূর, শর্টকাট পথ ছিল: চৌরঙ্গী মোড় গেঁথে, বিরাট একটা বাশ বাগানের পেছন দিয়ে, হাজী-বাড়ির পুকুর ঘেষে, বাদল-কে ভাসিয়ে নিয়ে, নুরুল আমীনে-র বাসার ‘আমেরিকান্’দের গুডমর্নিং বলে, পান্নু-কে বগলদাবা করে---- একছুটে রেল লাইন পাড় হয়ে জিলাস্কুলের হোস্টেল। “আনোয়ার বাড়ী যাবা না?” ওর বাবা সাবলীলভাবে ক্লাসরুমে ঢুঁকেই আদরমাখা গলায় বলতেন এবং বাড়ীও ছিল মধুপুর, ভাইসহ হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করা সেই আন্ওারের ঘর ছিল প্রথম ‘রাঁদেভু’ যেখানে পিক্নিকের সমস্ত হালাল উপাচার ক্রমশ জমা হতো। তৎকালে অবশ্য বে-হালাল উপাচার একটাই ছিল, সিগারেট: King Stork, সহজলভ্য কিন্তু দুষ্পাচ্য যার স্বী-কৃত নাম ছিল ‘বগা’। চিত্র দেখে শব্দ গড়ার>মৃত কে অমৃত করার>‘এটা দিয়ে ওটা ঠেকানোর’ সেটাই শুরু!
Bus তথা বাহন একটা বিরাট বোঝা: কেন যে এখনও আসে না! ‘দ’-রুপী হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে স্টার্ট নেবে কিনা? হেল্পার না থাকলেই ভালো, ছাদে বসা যাবে তো—এমনই কত কল্পনা, জল্পনা, দুরাশা ও হতাশা। দু-এক সময় এমন বাস পাওয়া যেতো যার কেবিন ছিল তিনটি: প্রথমটি ড্রাইভারের,পরেরটি জেনানা এবং তারপর মানেনা i.e.মরদ। বাস-এর ছাদে মাইক লাগিয়ে: হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং, কিছু do’s & don’ts, তারপর অনেকটা হঠাৎ করেই: ‘চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কি হবে...’--- ঝরঝরে সকালে সন্ধ্যা’র গান! As if, জানালা দিয়ে আমাদের দেখে কোনও এক কিশোরী শুয়ে শুয়ে আফ্সোসাচ্ছেন: ...জীবনে তোমায় যদি পেলাম না.....।আপনি বরং ‘সুখের ডাঙায় থাকুন শুয়ে’ মাদাম, ‘আনন্দেরেই সাগর থেকে এসেছে আজ বান’ আমাদের। গানের সাথে আমরাও সুধাচ্ছি: ‘..কত দূর আর কতদূর, প্রেমেরই সেই মধুপুর...’। জিলাস্কুলের মোড় ছুয়ে>সার্কিট হউসের মোড় পেঁচিয়ে>মুমিনুন্নেছার গা বাঁচিয়ে>বাঁ দিকের দুয়েকটি বাসার খালি বারান্দায় হতশ্বাস ঝুলিয়ে>‘অধিক–খাদ্য-ফলাও- অভিযান’এর পুলিশ লাইনস্ পেরিয়ে>ঝপাৎ করে জেলখানা:অবরুদ্ধ, আর ডানে পাতাকপি:আবদ্ধ, একটি ফুঁস্ছে আরেকটি গুম্রাচ্ছে। পাতাকপি-বাগানের পাশে শুয়ে থাকা আদি-ব্রহ্মপুত্র, নির্বিকার! ব্রহ্মার এই পুত্রটি অনাদি কাল থেকে শুয়েই আছেন, কুম্ভকর্ণ কোন্ ছার? তার প্রায় গা-ঘেঁসে গারো পাহাড়, মেঘালয় তথা ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ’। দোতলার সিড়িকোণে দু’এক জন রাজবন্দী তখন রোদ পোয়াচ্ছেন এবং ভাবছেন কি করে ‘আয়ুবশাহী ও মুনেমশাহী-কে অন্তত মোমেনশাহী থেকে নিপাত করা যায়’? আমাদেরই দু-একজন তখন বলে উঠেছে: ঐ যে শহিদুল্লাহ, রফিক ভুইয়া, হামিদ ভাই.....স্বগুম্ফ কাউকে দেখা গেলো, হয়তো শেখ মুজিব-ই! আরে হ্যাঁ, ঐ তো পাইপের ধোঁয়া, দূত হয়ে প্রিয়জনের কাছে যাচ্ছে দক্ষিণে---ঢাকা, গোপালগঞ্জে! এ বঙ্গে পাইপ অনেকেই টানতে পারে, কিন্তু কে আর ঐভাবে একই হাতে পাইপ আর ঘোড়া-মার্কা ম্যাচ ধরে রাখতে পারে, যেন, লাগাম ধরে আছেন? উনার পাইপ-টোবা্কো ছিল Erin more, মানে more, আর মুজিবের তখনকার কথা হচ্ছে ‘মোর অটনমি মাংতা হ্যায়’ যেটা শুনে দেশোয়ালী-ভাই, ছদর্-ই-রিয়াসত্, মুনেম খান বলতো, ‘লিয়াকত ক্বেয়া, ম্যায় খুদী তেরা ছের্ কুচাল দেঙ্গে, উসি লিয়ে তুম্কো মুমিন্সিং লে আয়া হু, আভি দেখ লেঙ্গে’।
কিন্তু চুনিয়া-কটেজের গাড়ী কোথায়? কি? আমাদের সামনে? কন্ডাক্টর ভাই, ইয়ে তো শরমকি বাত, তামাম মরদকুলের জন্য ইজ্জত-কা-সাওয়াল, বুলাও ড্রাইভারকো এবং দু’বাসের পাল্লাপাল্লির পর্যায়ে ‘চুনিয়াদের’ পাশ ঘেঁসে মুহূর্তেই ‘আমি অতিথি তোমারই দ্বারে’। সেইক্ষনে এবং সেইখানে:
‘একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি,
একটি কথার দ্বিধাথরথরচূড়ে বাসা বেঁধেছিল সাতটি আমরাবতী,
এবং তারপর দ্বিধা ঝেরে “দুচোখে দুচোখ পাতিয়া শুধালে: কোথা ছিলে এতদিন?” ক্ষেত্র,পাত্র ও সময়ভেদে ‘সাতটি-অমরাবতী’ সত্তর অথবা তদুর্ধ হতো, অনুযোগ হতো শুধুই যোগ, তবে যারা দুধের-স্বাদ-ঘোলে মেটাতে বাধ্য হতেন তারা ‘অমরাবতী’র দু’এক কলি ও অনুযোগের দু’এক লাইন, পরবর্তীতে শোনতে পেতেন ‘অমরাবতী নাট্য মন্দির’ তথা ছায়াবানী সিনেমা হল-এ রুপালি পর্দার গানে: ...... চোখ যে মনের কথা বলে, চোখে চোখ রাখা শুধু নয়, চোখের সে ভাষা বুঝতে হলে, চোখের মত চোখ থাকা চাই... একটা সিনেমাও ছিল: ‘আঁখিমিলন’। তা দেখে ঘোলপায়ীদের স্বতোৎসারিত কান্না ছিল ফোঁপানো, কিন্তু দুধপায়ীদের ঝোপানো কান্না এখনও চলছে যাদের দু’একজনের ইতিমধ্যে ছানিও পড়েছে আর একজন, চোখের ডাক্তার হয়ে রোগীদের পুছ্ করে: ‘এটায় ভালো না ওটায়’? একজন দ্যাবদ্যাবে নাকি বলেছিলেন,‘দু’টোই চাই’! চুকাও ল্যাঠা!
রেল লাইন পার হয়ে শওকতের নানা বাড়ীর তালগাছ ছুঁয়ে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা... সে-ই মুক্তাগাছা: জমিদার, মণ্ডা, মামাবাড়ী ও এয়ার গান্---সমস্ত আব্দারের লাস ভেগাস! এই মুক্তাগাছায় অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি আছে ‘আর্তাশ্রম’ যার ইংরেজি হচ্ছে infirmary। বিলেতে আদিকালের সমস্ত হসপিটালই infirmary এবং বাস ও রেলে কিছু কিছু সীট থাকে যেগুলির প্রাধান্য হচ্ছে ‘for aged, pregnant & infirm’. Infirm শব্দটির বাংলা হচ্ছে অশক্ত এবং বাংলাদেশে অন্তত একটি Infirmary তথা অশক্তালয় রয়েছে, চিটাগাঙে: ‘Eye infirmary’ তথা ‘চোক্ষাশক্তালয়’, অনেকের মধ্যে তাদের জন্যও যারা ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে......’ অর্থাৎ চোখকে যারা শুধুমাত্র ‘তাকানো’র কাজে লাগিয়েছেন ‘দেখা’র জন্য নয়, ‘করা’র তো প্রশ্নই উঠে না! পিক্নিকের-বাস থেকে এমন চলে-যাওয়া আমরা অনেক দেখ্তাম ‘শুধু দেখা পাওয়া, শুধু ছুয়ে যাওয়া, শুধু দূরে যেতে যেতে ফিরে চাওয়া’ কারন ‘এই মনটা যদি সিরাজ সাজে,ভাগ্য মীরজাফর... বুঝলে লটবহর?
তা পিক্নিকের লটবহর কি কি ছিল? কলা,পাউরুটি, সেদ্ধ ডিম, মাটির গেলাস,লাকড়ি, মাংস, কক্কক্, সুগন্ধি কালিজ্বীরা চাল, মটরশুঁটি, ঘি, মশলাদি, কিসমিস, খ্বীরা, চিনি, দুধ ও চা’পাতা। ড্রাইভার ও কন্ডাক্টর, বাবুর্চি ও তদীয় খেদমত্গার এবং গ্রামোফোনের ‘গানওয়ালা’-- এরা ছিল হংসমাঝেবকযথা! বেচারারা দার্শনিক ঔদাসিন্যে ভেতরের ও প্রানিবিদের ঔৎসুক্যে বাইরের বাঁদরামি দেখত, কি ভাবতো সেটা Origin of Species গ্রন্থে কিছুটা ইংগিত দেয়া আছে। স্নর্তব্য, মধুপুরের জঙ্গলে হনুমান এবং বাঁদর যথেষ্ট ছিল এবং ময়মন্সিং-টাঙ্গাইল রাস্তা ছেড়ে বাস যখন ন্যাশনাল পার্কের রাস্তা ধরত, তখন থেকেই ভেতরে চন্মন্ এবং বাইরে বন বন অবস্থা এবং সেটাকে উশকে্ দেবার জন্য হনুমানজীর হুম্হাম, আদিবাসীনির খুন্সুটি ও শাল-ভূতের ছম্ছম্ আবশ্যক ছিল আর সেই ছটফটে অবস্থা উদ্বেল হবার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি সুড়সুড়ি যা লাগতো রাস্তা থেকে, কারন ন্যাশনাল পার্কের রাস্তা ছিল রেল লাইনের মত(===)শুধু গাড়ীর চাকা যাবার অংশটুকু বাঁধানো তবে খস্খসে ফলে সির্সিরে্, এরও বাড়া, দু’লাইনের মাঝে ও পাশে বেশ বড় বড় বুনো ঘাস, গাড়ীর তলপেট সুড়সুড়িয়ে সমস্ত দেহে একটা শিহরন তূলে মৃদু মৃদু ঝাঁকুনি:... বলো ভালো আছো তো, আজ আবার সেই পথে দেখা হয়ে গেল...। সে-ই পথ! এমনই ঝাঁকুনির শেষে হালকা গোঙানির পর ফিস্ফিস্ কোরে: ‘নট্ নরন চড়ন নট্ কিস্সু’, কোত্থাও যাবোনা! মানে ইঞ্জিন নিঃস্ব, কারন পানি কমেছে। সামনের বনেটে ঝুলানো বালতি নিয়ে কন্ডাক্টরের ‘জলছত্র’ শরন, ফিরতে ‘দিরং’ অর্থাৎ দেরি হবে। ইত্যবসরে সবাই ঝুরঝুর করে নেমে, আশেপাশের যত শালগাছ আছে তার গোঁড়ায় গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে ‘লিখে রাখো এক ফোটা দিলেম শিশির’ যেগুলি জড়ো কোরে রেডিয়েটরে দিলেও হতো: কারন পাকিস্তান আমলের জিনিষ, কিছুটা ব্রিটিশ সৌরভ তখনও রয়েছিল! জলবিয়োগের পর কাজ হচ্ছে খুব কায়দা করে সিগারেট ধরিয়ে খক্খক্ করে কাশা যা শুনে ‘বান্দর’রা মনে করতো তাদের সাথে ইয়ার্কি মারা হচ্ছে, বেশী-পাঁকাদের-বানানো ধুঁয়ার রিঙ দেখে হিংসেয় গোঁফ পাকানো>তাতানো এবং গরম হবার আগেই দেব-আনন্দের ফুঁৎকারে গাওয়া: ...ম্যায় জিন্দেগি কা সাথ নিভাতা চালা গায়া, হার ফিক্রেকো ধুমে মে উড়াতা চালা গায়া...। এই ধূম্-কে রিঙ বানানোর মুহূর্তেই কোথা থেকে ‘এক হাওয়াকা ঝোকা’ এসে অর্ধবৃত্তাকৃতি ধোয়াকে লণ্ডভণ্ড করে দু’একটা শুক্না পাতা নিয়ে একটা মিনি টর্নেডো হয়ে শালগাছের মাথা ডিঙ্গিয়ে ‘মনে সাধ কালোমেঘ ছুঁয়ে যায়...বহুদূর উড়ে যায়’। ভিন্নস্থানে ও ভিন্নসময়ে, একবার এ হাওয়া ‘চোলী’ উড়িয়ে এনে মুখের উপর ফেলেছিলো, শুধু চোখ দুটোকে বিশেষ-ছাড় দিয়ে এবং সেই বিস্ময়, বিমুগ্ধ, বিমূঢ় দৃষ্টির কাছে আনত চোলী-হীনা পরে গাইতো: ‘সেই চোখ কোথায় তোমার, যেই চোখ দিয়ে তুমি আমায় প্রথম দেখেছিলে...কিছু না বলে শুধু চেয়ে চেয়ে অনেক কথাই বলেছিলে...’। পরে অবশ্য, সেই ‘আনত দিঠির’ মানে বুঝে ‘চিকুরের ঘ্রান’ নিতে নিতে ‘প্রলয়ের পথ অবারিত’ করতে কোনও শর্মাই পিছু পা হন নি। পুনরায় মুখ-সংযোগের মুখে দুলতে দুলতে এবং দোলাতে দোলাতে কন্ডাক্টরের খুট্খাট,বনেট আলগা করে রেডিয়েটরের মুখ খোলা---ভুস্ স্ স্ করে গরম বাতাসের ফানুশ ‘কাঁহা কাঁহা মুল্লুক্মে... উড়ে যেত ‘Like a child from the womb, like a ghost from the tomb’. অতঃপর খুব সাবধানে অতি-মহার্ঘ ঠাণ্ডা পানিকে ভেতরে ঢেলে, বনেট-এর দুই পার্ট সাঁটিয়ে, স্টার্টার ক্রমশ ঘোরানো এবং খক্, খক্খ, খখখ, খখখখ তুল্য কিছু শব্দ দিয়ে কপট বিরক্তি প্রকাশ করে আড়মোড়া ভেঙ্গে ইঞ্জিনের ‘ফির পাহ্লেছে’। ‘উঠো মুসাফির বাঁধো গাঁঠরি’---ন্যাশনাল-পার্ক হনুজ দুর-অস্ত্।
কিন্তু ‘ওরা’ কোথায়? সেই দু’লহরী বেণী, যা পেছনে দুল্লে ‘পরান সহিত মোর’ আর ঝপাৎ করে সামনে ফেল্লে “মাই-ই রে, ম্যায় ক্যায়সে কাহু পিঁর, আপ্নে যিয়া ক্যা কাহানি...”! অনেক পরে মনে হয়েছিলোঃ ‘একবেণী হিয়া’ নয় সুধীন দত্তের কবিতায় পাওয়া গেলো, দু’বেনী পাওয়া গেলো মুমিন্সিঙ্গে কিন্তু ত্রিবেণী পেতে হলে কি সঙ্গমেই যেতে হবে? সেখানকার বেনী-ও কি এমন লহরী নাকি বাহারী? ‘সেই বেনীমাধবী’ যে কোথায় গেল, আর দেখা হোলই না, কে জানে কোথায় কোন্ ‘ডাকাত স্বামীর ঘরে চার সন্তানের জননী’ হয়ে ‘পুনরাবৃত্ত রসনা’ শেষে পাশ ফিরে শুয়ে গান শোনে: ‘গুজরা হুয়া জামানা আতা নেহি দুবারা, হাফিয খোদা তুম্হারা...’।
ন্যাশনাল পার্কের মূল পিকনিক স্পট্টা খুবই সুন্দর, একটা রেস্ট-হউস, পাশে বসার জায়গা, বেশ বড়---কাঁটাতার ঘেরা, ঢালুতে চাষের জমি, সেটা পেরুলেই চুনিয়া কটেজ ‘যেথা রামধনু উঠে হেসে আর ফুল ফুটে ভালোবেসে’----খুবই সুন্দর একটা ফুলবাগান ছিল ওখানে। ওর সামনের রাস্তা ধরে দূরের গাঁয়ে যাওয়া যেত, যেখানে অনেক কিছুর মধ্যে ছিল আনারস বাগান আর গিদ্ধর। অনেক সাধ নিয়ে এবং অনেক সাধনা করে দু’একচুমুক পাওয়া যেত এবং তারপর হঠাৎ করে যুগপৎ গিদধ্রদের ঘোৎ ঘোঁত এবং ‘দো’পায়ীদের হড়হড় করে গান----সুর, তাল, লয়ের থোড়াই পরোয়া! একটা গান, পশ্চিম-পাকিস্তানী গায়ক ও অভিনেতা, রঙ্গিলার: ‘গা মেরে মনুয়া, গা তা যারে, যানা হে হামকা দূর...’ মুমিন্সিং শহরের মেথররা গাইতো দ্রব্যগুণে আর মধুপুরের পিক্নিকাররা গাইতো ‘দো’ অথবা ‘চার’-এর গুনে।
‘যানা হে হামকা দূর...’ বললেও বেশী দূর যাবার উপায় ছিল না, হাবুল অর্থাৎ ‘আজীবন-ক্লাস-ক্যাপ্টেন’ দুপুর নাগাদ মাইক-এ ঘোষণা দিত, খাবার নজ্দিগ সুতরাং কলাপাতা ধুয়ে-মুছে পংতিভুক্ত হবার জন্য। সমবয়সী হলেও অনেকেই তাকে ‘হাবুল ভাইজান’ ডেকে কাপ্তেনী করার নিঃশর্ত আধিকার দিত। মনে হয় তাকে নিয়েই লিখা O Captain, my captain… ! পুর্নমিলণী হলে এখনও ভাইজানই ‘মুশ্কিল আছান’! মূল পিকনিক স্পট্টার মাঝখানে একটা বৃত্তাকার কাঠের টেবিল, উপরে ছাওনি---- টেবিল ও ছাওনির কড়ি-বর্গায় হাল্কা থেকে মাঝারি মানের খোদাই করে অসংখ্য নাম লিখা, কিছু নাম আবার যুগলবন্দী যেমন: রেখা+ফারুক। ঐ চত্বরে বসে খাবার ও খোদিত হবার ইচ্ছা অনেকেরই হত কিন্তু ‘ঠাই নাই’। কলাপাতা বিছিয়ে তার মাঝে মটর-পোলাও, ক্রমে মুর্গী, ততঃক্রমে সালাদ—১ম পর্ব। ২য় পর্বে পোলাও, খাসী ও সালাদ এবং পর্ব-নির্বিশেষে: ‘... হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিঃশব্দ, পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে...’। সেই পাতা গুলি জড়ো করে এক জায়গায় ফেলার একটা আদেশ এবং নির্দেশিত স্থান ছিল, যেখানে অচিরেই বেশ কিছু কুকুর হুটোপুটি করে মোড়ানো পাতা খুলে পিপড়েদের উপর ‘রেগে কাঁই’! এই রোয়াঁ-উঠা কুকুরের মুখে অন্যায্য গালি খাবার মনোকষ্টে, পিঁপড়াদের পণ দেখেই সম্ভবত কবি লিখেছিলেন... ‘এক পিঁপড়ে অনেক চেষ্টাতে হায় শেষটাতে... বেয়ে বেয়ে উঠে সেই দেশটাতে... যেথা শুধু মধূ R মধূ’। R=Ravine
আচ্ছা ‘ওরা’ কি খেলো? আমাদের কথা একটুও মনে হয় নি? ‘ও’-ই বা কি খেলো? আরে হ্যাঁ, ঐ যে: নাদিরা যার নাম, বড় বড় চোখ, ছোট ছোট লেখায় যে বলে: ‘তোমার সকল দুখের প্রদীপ হয়ে আমিই জ্বলবো’। তবু চিনলেন না? আরে যন্ত্রণা! দু’বেনী তো এই সাড়ে-সাতকোটির দেশে একজনেরই হয়! সাবধান, এক বারের বেশী তাকাবেন না কিন্তু, কারন ‘বেতের ফলের মত’ ঐ চোখ: স্পষ্ট ও ব্যাক্ত--আশ্রয় ও প্রশ্রয়, যার আশ্রয়ে বাঘ হয় চিতা আর প্রশ্রয়ে? স্বপ্ন হয় প্রজাপতি!
শীতের দিন দীর্ঘ নয় তাই হঠাৎ করেই সন্ধ্যা এসে যেত: বেশ বিষণ্ণ ও একটু ঠাণ্ডা। লগ্ন এলো ভগ্ন করার----সেটা এক কষ্ট, তার সাথে ছট্ফটানি: ঐ বাসটাও একই সাথে ছাড়বে তো? মধুপুরে বাঘ অশ্রুত নয়, আশ্রয় পেলে চিতা হয়ে ভস্ম করতে মোটেই সময় নেবে না! সুতরাং একটু খবরদারির ভাব এসে যেতেই পারতো। তাই হঠাৎ করেই: ‘হ্যালো মাইক্রোফোন’ এর মাধ্যমে একটু ভয় ছড়িয়ে, ‘আমরা যাচ্ছি’ মার্কা একটা ভাব দুলিয়ে, ‘ও’দের ফেরত যাত্রা কে ত্বরান্বিত ও সমন্বিত করার চেষ্টা, তাতেও না কুলালে ‘চুনিয়াদের’ গলির মাথায় বসে গান গাওয়া: ‘ ...এক ঘর বানাউঙ্গা তেরে ঘর কি সাম্নে, দুনিয়া বাসাউঙ্গা তেরে ঘর কি সাম্নে ...’। যায়েগা কাঁহা?
ফেরার প্রস্তুতি অনেক: লটবহর গোছানো, অকুস্থল পরিষ্কার, কুকুরদের কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং পিঁপড়েদের কোমর জড়িয়ে একটু আদর ও সামনের বার আরেকটু উদার হবার প্রতিশ্রুতি। জংগল থেকে সংগৃহীত ‘গীলা’ গুলি পকেটে যাচাই করা, আর বুকপকেটে হাত বুলিয়ে সর্বশেষ চিঠিটার ওম্ নেয়া, যার একটি লাইন ছিল: ‘আমার সমস্ত ভালোবাসা নারকেলের মত কুঁড়িয়ে কুঁড়িয়ে তোমাকে দিলাম’। মধুপুরের কারনেই ভাষাটা দেহাতী তবে ভাবটা দেহাশ্রয়ী কারন নারকেল গোলাকার তেমনই কতকিছুই গোলাকার, এমনই এক গোল-এর বর্ণনা পাওয়া গেল আত্মজার কাছে নেলসন মেন্ডেলার লিখিত এক চিঠিতে যেখানে তিনি বলেছেন: 'মেয়েদের স্তন হবে কামানের গোলার মত'। ফলে ‘নিমিষে এ মন পিয়াসী’!
ফিরতি পথে ঠাণ্ডা ঠেকানোর জন্য বাস-এর জানালা-দরজা সবই বন্ধ, ভেতরে: ম’ধুম গান, ইত্যকার ইয়ার্কি এবং স্বধুম সিগারেট, তারসাথে সকালে খাওয়া সেদ্ধ-ডিম-উদ্ভূত-'বায়ু', যা আশা ভোশ্লের সাথে গলা মিলিয়েই যাচ্ছে:...যেতে দাও আমায় ডেকো না......। কে কাকে রোখে?
হঠাৎ কোরেই ঐ, ঐ যায়, মানে, আমাদেরকে পেছনে ফেলে চুনিয়াদের বাস এগুচ্ছে, পরাত পরাত করে বাসের জানালাগুলি হাঁটু পর্যন্ত নামিয়ে ‘হুমড়ি খেয়ে পড়লো সারি সারি’ কিন্তু ওদের সব গবাক্ষ কুলুপ এঁটে আমাদের সাথে কটাক্ষ করছে, তখন গান হচ্ছিলো...... 'শেষ প্রহরের ভীরু নয়ন ব্যথায় ছলছল, তবু তুমি নীরব কেন একটু কিছু বল...’। না, সেই অধরা বলেনি কিছুই, লিখেছে অনেক, আর বলেছে প্রজাপতির কাছে:
‘সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরেও,
আমি ভুলিবোনা’। photo
বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩
infirmary মুক্তাগাছায় অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি আছে 'আর্তাশ্রম' যার ইংরেজি
পিক্নিক
কৈশোরের শেষাংশ কেটেছে পূর্ব-পাকিস্তানে আর যৌবনের উদ্গম হয়েছে সদ্যস্বাধীন-বাংলাদেশে এবং সুকান্তের ভাষায় ‘জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভুমি...’। ক্ষুব্ধতার বিভিন্নরুপ প্রকাশের মধ্যে এক রুপ ছিল: দম্ মারো দম্, বৈষ্ণবীরুপ জীনাত আমান, খঞ্জনীরুপ কল্কী, প্রায় অজানুলম্বিত জুলফি, পুরুস্ঠু কটিবন্ধনী, বেলবটম ট্রাউজার্স, সুউচ্চ জুতা এবং তালে-বেতালে ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা...’। অন্য রুপ ছিল: খামোখাই বেয়াদপী: ‘মানিনা কো কোনও আইন, ভরা তরী করি ভরাডুবি, ভীম, ভাসমান-মাইন’। সে মাইন-এ ছিন্ন-ভিন্ন হয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান যাকে পাকিস্তানীরা ‘ক্বতল্’ করতে পারে নি, কিন্তু বাঙালীরা খুন করার যুক্তি পেয়েছিল। মনে হয় শেখ মুজিব অন্তিম মুহূর্তে বিশ্বাসই করে উঠতে পারেন নি: তার গায়ে যা লেগেছে তা গুলি, যা বেরুচ্ছে তা রক্ত, এবং যারা তাকে গুলি করলো তারা “আর যদি আমার লোকের উপর হত্যা করা হয়” ঘোষিত ‘আমার লোক’! উনার শেষ মুহূর্তগুলি সম্ভবত অবিশ্বাসের দমকে নিঃশেষিত হয়েছিলো। বিশ্বাসী মানুষ, কিন্তু মউত কবুল করেছেন অবিশ্বাসী হয়ে। মানবীয় বাংলার এ এক দানবীয় রুপ যার পুনঃপৌনিকতা থামানোই যাচ্ছে না! ’৪৭-এর পর থেকে পশ্চিম-পাকিস্তানীরা যে বেয়াদপী করেই যাচ্ছিলো এবং বাঙালীরা প্রত্যুত্তরে তাদের স্বভাবসিদ্ধ-আদব-ভঙ্গ-করে, ’৭১-এ ‘যেমন কুকুর তেমন মুগুর’ চালাতে সক্ষম হোল, ১৬ই ডিসেম্বরের পর থেকে সেই ‘মুগ্রামী’ অভ্যাসে পরিণত হয়ে অনেক কিছুর মধ্যে এও বলে বসতে বাধ্য হোলো: ‘...ভাত দে হারামজাদা, তা নইলে মানচিত্র খাব...’। এই যৌক্তিক-ক্ষুধাগুলি মেটানোর একটি সমন্বিত পথ আমরা এখনও বের করে উঠতে পারি নি, যা আকারে ও প্রকারে বেড়েই চলেছে, তাই আগের মানচিত্রেও কুলোবে বলে মনে হয় না: তা কি দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর শুষে নেবে নাকি উত্তরে হিমালয় গিলে খাবে তা ক্রমপ্রকাশ্য।
যাহোক, বিশেষত কৈশোরে এবং প্রধানত শীতকালে পিক্নিক বলে একটা চাঞ্চল্য ছিল—কল্পনায়, বাস্তবে, উত্তেজনায়, উন্মাদনায় অনন্য। বিভিন্ন পর্যায়ে অনুমতি মিলবে কিনা সেটা দুরুদুরু, হান্নান সাহেব Bus দেবেন তো? গ্রামোফোনে কি কি গান হবে? সকালে ঘুম ভাঙ্গবে তো! এত সকালে কিভাবে পৌছব? এত শীত কেন? সবাই আসবে তো! শরীফ যদি সিগারেট কিনতে না পারে--তাহলে তো ও একটা ‘শালা’। আচ্ছা, বিদ্যাময়ী স্কুলের ‘ওরা’ নাকি চুনিয়া-কটেজে যাবে! সত্যিই?
ইত্যকার শর্ত মেনে নিয়ে, কল্পনায় মোড়ানো ঘুম হতে জেগেই দেখি, কুয়াশায়-নিড়ানি-দেয়া-সূর্যকিরণ কাটা-ঘুড়ির মত ক্রমশ নতমুখী হয়ে এগিয়ে পাতায় পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুকে আলতো করে জড়িয়ে পতনকে ত্বরান্বিত করছে, আর পতিত বিন্দু শিউলি ফুলের মত টুপ্ টুপ্ করে ঝাপ দিয়ে নীচে ঘাসের উপর জমে থাকা বিন্দুগুলিকে মিলিয়ে বড় বিন্দু হয়ে নীচের ভূমিকে ভিজিয়ে দেবার দুষ্টুমিতে মগ্ন, আর ভুমিও খুব সহজিয়া-অনুরাগে বাইরের ও স্বতঃস্ফুর্ততার সাথে ভেতরের দ্বার খুলে, সমস্ত কোমলতা বিছিয়ে, সেই উষ্ণ-বিন্দুর সাথে স্বেদবিন্দু মিশিয়ে নিষিক্ত হয়ে, অজানা খুশিতে অনামা সৃষ্টিতে মত্ত। এ জন্যই কি কবি লিখেছিলেন: ‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশিরভেজা ঘাসে, সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোঁদে হাসে’। সারা রাতের স্বপন তো অ-নে-ক আর তার বৈচিত্রেরই কি কোনও অগ্রপশ্চাৎ থাকতো? সেটা ছিল স্বপ্ন দেখার ও দেখানোর বয়স... যার রেশ: ‘সেই থেকে শুধু শুধু স্বপ্ন নিয়ে খেলা চলেছে, রাতের আকাশ ভেঙে একরাশ তারা যেন উড়ে চলেছে...’। আর সেই সুব্হে-সাদেকে সৃষ্টি-সুখের-উল্লাস প্রার্থী কেউ যদি রেয়াজ করে... ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়...’ সে সর্বনাশ ঘটাতে কার না মন চাইবে? সে বয়সে ‘সকল’ আর কতটুকুই ছিল কিন্ত ‘সর্বনাশে’ ভেসে যাবার আকুতি ছিল প্রচণ্ড যা চন্বনিয়ে উঠতো ক্ষণপরে আশা’র সেই গান শুনে: ‘কেন সর্বনাশের নেশা ধরিয়ে তুমি এলে না যে, মন লাগে না আর কোনও কাজে...’। এ তো অনুযোগ নয়, রীতিমত একটা চ্যালেঞ্জ! এই ধরনের এক চ্যালেঞ্জ মুকাবিলায় মুখ-দিয়ে-ফিতা-খুলতে-যেয়ে গিট্টু বাঁধিয়ে, এক কিশোর পরবর্তীতে কিশোরী কর্তৃক কটাক্ষিত হতো ‘গিট্টু’ বলে!
সেই কুয়াশা-কাঁদা-ভোরে কোনোমত একটা কিছু মুখে গোজার ভাব করে ‘... রাত্রির ভয় তার চেয়ে ভয়, কখন সূর্য্য উঠে’? দরদে যাদের চোখ কাঁপত, তাদের মধ্যে মা অন্যতম, অপ্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রে মুড়িয়ে “গলা ঢেকে রাখো ও রেখো”, খোদাহাফেজ-মাখা-বরাভয়,অতঃপর ‘...পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে এ পথ চেনা’। বাসা থেকে স্কুল বেশ দূর, শর্টকাট পথ ছিল: চৌরঙ্গী মোড় গেঁথে, বিরাট একটা বাশ বাগানের পেছন দিয়ে, হাজী-বাড়ির পুকুর ঘেষে, বাদল-কে ভাসিয়ে নিয়ে, নুরুল আমীনে-র বাসার ‘আমেরিকান্’দের গুডমর্নিং বলে, পান্নু-কে বগলদাবা করে---- একছুটে রেল লাইন পাড় হয়ে জিলাস্কুলের হোস্টেল। “আনোয়ার বাড়ী যাবা না?” ওর বাবা সাবলীলভাবে ক্লাসরুমে ঢুঁকেই আদরমাখা গলায় বলতেন এবং বাড়ীও ছিল মধুপুর, ভাইসহ হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করা সেই আন্ওারের ঘর ছিল প্রথম ‘রাঁদেভু’ যেখানে পিক্নিকের সমস্ত হালাল উপাচার ক্রমশ জমা হতো। তৎকালে অবশ্য বে-হালাল উপাচার একটাই ছিল, সিগারেট: King Stork, সহজলভ্য কিন্তু দুষ্পাচ্য যার স্বী-কৃত নাম ছিল ‘বগা’। চিত্র দেখে শব্দ গড়ার>মৃত কে অমৃত করার>‘এটা দিয়ে ওটা ঠেকানোর’ সেটাই শুরু!
Bus তথা বাহন একটা বিরাট বোঝা: কেন যে এখনও আসে না! ‘দ’-রুপী হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে স্টার্ট নেবে কিনা? হেল্পার না থাকলেই ভালো, ছাদে বসা যাবে তো—এমনই কত কল্পনা, জল্পনা, দুরাশা ও হতাশা। দু-এক সময় এমন বাস পাওয়া যেতো যার কেবিন ছিল তিনটি: প্রথমটি ড্রাইভারের,পরেরটি জেনানা এবং তারপর মানেনা i.e.মরদ। বাস-এর ছাদে মাইক লাগিয়ে: হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং, কিছু do’s & don’ts, তারপর অনেকটা হঠাৎ করেই: ‘চন্দন পালঙ্কে শুয়ে একা একা কি হবে...’--- ঝরঝরে সকালে সন্ধ্যা’র গান! As if, জানালা দিয়ে আমাদের দেখে কোনও এক কিশোরী শুয়ে শুয়ে আফ্সোসাচ্ছেন: ...জীবনে তোমায় যদি পেলাম না.....।আপনি বরং ‘সুখের ডাঙায় থাকুন শুয়ে’ মাদাম, ‘আনন্দেরেই সাগর থেকে এসেছে আজ বান’ আমাদের। গানের সাথে আমরাও সুধাচ্ছি: ‘..কত দূর আর কতদূর, প্রেমেরই সেই মধুপুর...’। জিলাস্কুলের মোড় ছুয়ে>সার্কিট হউসের মোড় পেঁচিয়ে>মুমিনুন্নেছার গা বাঁচিয়ে>বাঁ দিকের দুয়েকটি বাসার খালি বারান্দায় হতশ্বাস ঝুলিয়ে>‘অধিক–খাদ্য-ফলাও- অভিযান’এর পুলিশ লাইনস্ পেরিয়ে>ঝপাৎ করে জেলখানা:অবরুদ্ধ, আর ডানে পাতাকপি:আবদ্ধ, একটি ফুঁস্ছে আরেকটি গুম্রাচ্ছে। পাতাকপি-বাগানের পাশে শুয়ে থাকা আদি-ব্রহ্মপুত্র, নির্বিকার! ব্রহ্মার এই পুত্রটি অনাদি কাল থেকে শুয়েই আছেন, কুম্ভকর্ণ কোন্ ছার? তার প্রায় গা-ঘেঁসে গারো পাহাড়, মেঘালয় তথা ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ’। দোতলার সিড়িকোণে দু’এক জন রাজবন্দী তখন রোদ পোয়াচ্ছেন এবং ভাবছেন কি করে ‘আয়ুবশাহী ও মুনেমশাহী-কে অন্তত মোমেনশাহী থেকে নিপাত করা যায়’? আমাদেরই দু-একজন তখন বলে উঠেছে: ঐ যে শহিদুল্লাহ, রফিক ভুইয়া, হামিদ ভাই.....স্বগুম্ফ কাউকে দেখা গেলো, হয়তো শেখ মুজিব-ই! আরে হ্যাঁ, ঐ তো পাইপের ধোঁয়া, দূত হয়ে প্রিয়জনের কাছে যাচ্ছে দক্ষিণে---ঢাকা, গোপালগঞ্জে! এ বঙ্গে পাইপ অনেকেই টানতে পারে, কিন্তু কে আর ঐভাবে একই হাতে পাইপ আর ঘোড়া-মার্কা ম্যাচ ধরে রাখতে পারে, যেন, লাগাম ধরে আছেন? উনার পাইপ-টোবা্কো ছিল Erin more, মানে more, আর মুজিবের তখনকার কথা হচ্ছে ‘মোর অটনমি মাংতা হ্যায়’ যেটা শুনে দেশোয়ালী-ভাই, ছদর্-ই-রিয়াসত্, মুনেম খান বলতো, ‘লিয়াকত ক্বেয়া, ম্যায় খুদী তেরা ছের্ কুচাল দেঙ্গে, উসি লিয়ে তুম্কো মুমিন্সিং লে আয়া হু, আভি দেখ লেঙ্গে’।
কিন্তু চুনিয়া-কটেজের গাড়ী কোথায়? কি? আমাদের সামনে? কন্ডাক্টর ভাই, ইয়ে তো শরমকি বাত, তামাম মরদকুলের জন্য ইজ্জত-কা-সাওয়াল, বুলাও ড্রাইভারকো এবং দু’বাসের পাল্লাপাল্লির পর্যায়ে ‘চুনিয়াদের’ পাশ ঘেঁসে মুহূর্তেই ‘আমি অতিথি তোমারই দ্বারে’। সেইক্ষনে এবং সেইখানে:
‘একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে,
থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি,
একটি কথার দ্বিধাথরথরচূড়ে বাসা বেঁধেছিল সাতটি আমরাবতী,
এবং তারপর দ্বিধা ঝেরে “দুচোখে দুচোখ পাতিয়া শুধালে: কোথা ছিলে এতদিন?” ক্ষেত্র,পাত্র ও সময়ভেদে ‘সাতটি-অমরাবতী’ সত্তর অথবা তদুর্ধ হতো, অনুযোগ হতো শুধুই যোগ, তবে যারা দুধের-স্বাদ-ঘোলে মেটাতে বাধ্য হতেন তারা ‘অমরাবতী’র দু’এক কলি ও অনুযোগের দু’এক লাইন, পরবর্তীতে শোনতে পেতেন ‘অমরাবতী নাট্য মন্দির’ তথা ছায়াবানী সিনেমা হল-এ রুপালি পর্দার গানে: ...... চোখ যে মনের কথা বলে, চোখে চোখ রাখা শুধু নয়, চোখের সে ভাষা বুঝতে হলে, চোখের মত চোখ থাকা চাই... একটা সিনেমাও ছিল: ‘আঁখিমিলন’। তা দেখে ঘোলপায়ীদের স্বতোৎসারিত কান্না ছিল ফোঁপানো, কিন্তু দুধপায়ীদের ঝোপানো কান্না এখনও চলছে যাদের দু’একজনের ইতিমধ্যে ছানিও পড়েছে আর একজন, চোখের ডাক্তার হয়ে রোগীদের পুছ্ করে: ‘এটায় ভালো না ওটায়’? একজন দ্যাবদ্যাবে নাকি বলেছিলেন,‘দু’টোই চাই’! চুকাও ল্যাঠা!
রেল লাইন পার হয়ে শওকতের নানা বাড়ীর তালগাছ ছুঁয়ে ‘কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা... সে-ই মুক্তাগাছা: জমিদার, মণ্ডা, মামাবাড়ী ও এয়ার গান্---সমস্ত আব্দারের লাস ভেগাস! এই মুক্তাগাছায় অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি আছে ‘আর্তাশ্রম’ যার ইংরেজি হচ্ছে infirmary। বিলেতে আদিকালের সমস্ত হসপিটালই infirmary এবং বাস ও রেলে কিছু কিছু সীট থাকে যেগুলির প্রাধান্য হচ্ছে ‘for aged, pregnant & infirm’. Infirm শব্দটির বাংলা হচ্ছে অশক্ত এবং বাংলাদেশে অন্তত একটি Infirmary তথা অশক্তালয় রয়েছে, চিটাগাঙে: ‘Eye infirmary’ তথা ‘চোক্ষাশক্তালয়’, অনেকের মধ্যে তাদের জন্যও যারা ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে......’ অর্থাৎ চোখকে যারা শুধুমাত্র ‘তাকানো’র কাজে লাগিয়েছেন ‘দেখা’র জন্য নয়, ‘করা’র তো প্রশ্নই উঠে না! পিক্নিকের-বাস থেকে এমন চলে-যাওয়া আমরা অনেক দেখ্তাম ‘শুধু দেখা পাওয়া, শুধু ছুয়ে যাওয়া, শুধু দূরে যেতে যেতে ফিরে চাওয়া’ কারন ‘এই মনটা যদি সিরাজ সাজে,ভাগ্য মীরজাফর... বুঝলে লটবহর?
তা পিক্নিকের লটবহর কি কি ছিল? কলা,পাউরুটি, সেদ্ধ ডিম, মাটির গেলাস,লাকড়ি, মাংস, কক্কক্, সুগন্ধি কালিজ্বীরা চাল, মটরশুঁটি, ঘি, মশলাদি, কিসমিস, খ্বীরা, চিনি, দুধ ও চা’পাতা। ড্রাইভার ও কন্ডাক্টর, বাবুর্চি ও তদীয় খেদমত্গার এবং গ্রামোফোনের ‘গানওয়ালা’-- এরা ছিল হংসমাঝেবকযথা! বেচারারা দার্শনিক ঔদাসিন্যে ভেতরের ও প্রানিবিদের ঔৎসুক্যে বাইরের বাঁদরামি দেখত, কি ভাবতো সেটা Origin of Species গ্রন্থে কিছুটা ইংগিত দেয়া আছে। স্নর্তব্য, মধুপুরের জঙ্গলে হনুমান এবং বাঁদর যথেষ্ট ছিল এবং ময়মন্সিং-টাঙ্গাইল রাস্তা ছেড়ে বাস যখন ন্যাশনাল পার্কের রাস্তা ধরত, তখন থেকেই ভেতরে চন্মন্ এবং বাইরে বন বন অবস্থা এবং সেটাকে উশকে্ দেবার জন্য হনুমানজীর হুম্হাম, আদিবাসীনির খুন্সুটি ও শাল-ভূতের ছম্ছম্ আবশ্যক ছিল আর সেই ছটফটে অবস্থা উদ্বেল হবার জন্য প্রয়োজন ছিল একটি সুড়সুড়ি যা লাগতো রাস্তা থেকে, কারন ন্যাশনাল পার্কের রাস্তা ছিল রেল লাইনের মত(===)শুধু গাড়ীর চাকা যাবার অংশটুকু বাঁধানো তবে খস্খসে ফলে সির্সিরে্, এরও বাড়া, দু’লাইনের মাঝে ও পাশে বেশ বড় বড় বুনো ঘাস, গাড়ীর তলপেট সুড়সুড়িয়ে সমস্ত দেহে একটা শিহরন তূলে মৃদু মৃদু ঝাঁকুনি:... বলো ভালো আছো তো, আজ আবার সেই পথে দেখা হয়ে গেল...। সে-ই পথ! এমনই ঝাঁকুনির শেষে হালকা গোঙানির পর ফিস্ফিস্ কোরে: ‘নট্ নরন চড়ন নট্ কিস্সু’, কোত্থাও যাবোনা! মানে ইঞ্জিন নিঃস্ব, কারন পানি কমেছে। সামনের বনেটে ঝুলানো বালতি নিয়ে কন্ডাক্টরের ‘জলছত্র’ শরন, ফিরতে ‘দিরং’ অর্থাৎ দেরি হবে। ইত্যবসরে সবাই ঝুরঝুর করে নেমে, আশেপাশের যত শালগাছ আছে তার গোঁড়ায় গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে ‘লিখে রাখো এক ফোটা দিলেম শিশির’ যেগুলি জড়ো কোরে রেডিয়েটরে দিলেও হতো: কারন পাকিস্তান আমলের জিনিষ, কিছুটা ব্রিটিশ সৌরভ তখনও রয়েছিল! জলবিয়োগের পর কাজ হচ্ছে খুব কায়দা করে সিগারেট ধরিয়ে খক্খক্ করে কাশা যা শুনে ‘বান্দর’রা মনে করতো তাদের সাথে ইয়ার্কি মারা হচ্ছে, বেশী-পাঁকাদের-বানানো ধুঁয়ার রিঙ দেখে হিংসেয় গোঁফ পাকানো>তাতানো এবং গরম হবার আগেই দেব-আনন্দের ফুঁৎকারে গাওয়া: ...ম্যায় জিন্দেগি কা সাথ নিভাতা চালা গায়া, হার ফিক্রেকো ধুমে মে উড়াতা চালা গায়া...। এই ধূম্-কে রিঙ বানানোর মুহূর্তেই কোথা থেকে ‘এক হাওয়াকা ঝোকা’ এসে অর্ধবৃত্তাকৃতি ধোয়াকে লণ্ডভণ্ড করে দু’একটা শুক্না পাতা নিয়ে একটা মিনি টর্নেডো হয়ে শালগাছের মাথা ডিঙ্গিয়ে ‘মনে সাধ কালোমেঘ ছুঁয়ে যায়...বহুদূর উড়ে যায়’। ভিন্নস্থানে ও ভিন্নসময়ে, একবার এ হাওয়া ‘চোলী’ উড়িয়ে এনে মুখের উপর ফেলেছিলো, শুধু চোখ দুটোকে বিশেষ-ছাড় দিয়ে এবং সেই বিস্ময়, বিমুগ্ধ, বিমূঢ় দৃষ্টির কাছে আনত চোলী-হীনা পরে গাইতো: ‘সেই চোখ কোথায় তোমার, যেই চোখ দিয়ে তুমি আমায় প্রথম দেখেছিলে...কিছু না বলে শুধু চেয়ে চেয়ে অনেক কথাই বলেছিলে...’। পরে অবশ্য, সেই ‘আনত দিঠির’ মানে বুঝে ‘চিকুরের ঘ্রান’ নিতে নিতে ‘প্রলয়ের পথ অবারিত’ করতে কোনও শর্মাই পিছু পা হন নি। পুনরায় মুখ-সংযোগের মুখে দুলতে দুলতে এবং দোলাতে দোলাতে কন্ডাক্টরের খুট্খাট,বনেট আলগা করে রেডিয়েটরের মুখ খোলা---ভুস্ স্ স্ করে গরম বাতাসের ফানুশ ‘কাঁহা কাঁহা মুল্লুক্মে... উড়ে যেত ‘Like a child from the womb, like a ghost from the tomb’. অতঃপর খুব সাবধানে অতি-মহার্ঘ ঠাণ্ডা পানিকে ভেতরে ঢেলে, বনেট-এর দুই পার্ট সাঁটিয়ে, স্টার্টার ক্রমশ ঘোরানো এবং খক্, খক্খ, খখখ, খখখখ তুল্য কিছু শব্দ দিয়ে কপট বিরক্তি প্রকাশ করে আড়মোড়া ভেঙ্গে ইঞ্জিনের ‘ফির পাহ্লেছে’। ‘উঠো মুসাফির বাঁধো গাঁঠরি’---ন্যাশনাল-পার্ক হনুজ দুর-অস্ত্।
কিন্তু ‘ওরা’ কোথায়? সেই দু’লহরী বেণী, যা পেছনে দুল্লে ‘পরান সহিত মোর’ আর ঝপাৎ করে সামনে ফেল্লে “মাই-ই রে, ম্যায় ক্যায়সে কাহু পিঁর, আপ্নে যিয়া ক্যা কাহানি...”! অনেক পরে মনে হয়েছিলোঃ ‘একবেণী হিয়া’ নয় সুধীন দত্তের কবিতায় পাওয়া গেলো, দু’বেনী পাওয়া গেলো মুমিন্সিঙ্গে কিন্তু ত্রিবেণী পেতে হলে কি সঙ্গমেই যেতে হবে? সেখানকার বেনী-ও কি এমন লহরী নাকি বাহারী? ‘সেই বেনীমাধবী’ যে কোথায় গেল, আর দেখা হোলই না, কে জানে কোথায় কোন্ ‘ডাকাত স্বামীর ঘরে চার সন্তানের জননী’ হয়ে ‘পুনরাবৃত্ত রসনা’ শেষে পাশ ফিরে শুয়ে গান শোনে: ‘গুজরা হুয়া জামানা আতা নেহি দুবারা, হাফিয খোদা তুম্হারা...’।
ন্যাশনাল পার্কের মূল পিকনিক স্পট্টা খুবই সুন্দর, একটা রেস্ট-হউস, পাশে বসার জায়গা, বেশ বড়---কাঁটাতার ঘেরা, ঢালুতে চাষের জমি, সেটা পেরুলেই চুনিয়া কটেজ ‘যেথা রামধনু উঠে হেসে আর ফুল ফুটে ভালোবেসে’----খুবই সুন্দর একটা ফুলবাগান ছিল ওখানে। ওর সামনের রাস্তা ধরে দূরের গাঁয়ে যাওয়া যেত, যেখানে অনেক কিছুর মধ্যে ছিল আনারস বাগান আর গিদ্ধর। অনেক সাধ নিয়ে এবং অনেক সাধনা করে দু’একচুমুক পাওয়া যেত এবং তারপর হঠাৎ করে যুগপৎ গিদধ্রদের ঘোৎ ঘোঁত এবং ‘দো’পায়ীদের হড়হড় করে গান----সুর, তাল, লয়ের থোড়াই পরোয়া! একটা গান, পশ্চিম-পাকিস্তানী গায়ক ও অভিনেতা, রঙ্গিলার: ‘গা মেরে মনুয়া, গা তা যারে, যানা হে হামকা দূর...’ মুমিন্সিং শহরের মেথররা গাইতো দ্রব্যগুণে আর মধুপুরের পিক্নিকাররা গাইতো ‘দো’ অথবা ‘চার’-এর গুনে।
‘যানা হে হামকা দূর...’ বললেও বেশী দূর যাবার উপায় ছিল না, হাবুল অর্থাৎ ‘আজীবন-ক্লাস-ক্যাপ্টেন’ দুপুর নাগাদ মাইক-এ ঘোষণা দিত, খাবার নজ্দিগ সুতরাং কলাপাতা ধুয়ে-মুছে পংতিভুক্ত হবার জন্য। সমবয়সী হলেও অনেকেই তাকে ‘হাবুল ভাইজান’ ডেকে কাপ্তেনী করার নিঃশর্ত আধিকার দিত। মনে হয় তাকে নিয়েই লিখা O Captain, my captain… ! পুর্নমিলণী হলে এখনও ভাইজানই ‘মুশ্কিল আছান’! মূল পিকনিক স্পট্টার মাঝখানে একটা বৃত্তাকার কাঠের টেবিল, উপরে ছাওনি---- টেবিল ও ছাওনির কড়ি-বর্গায় হাল্কা থেকে মাঝারি মানের খোদাই করে অসংখ্য নাম লিখা, কিছু নাম আবার যুগলবন্দী যেমন: রেখা+ফারুক। ঐ চত্বরে বসে খাবার ও খোদিত হবার ইচ্ছা অনেকেরই হত কিন্তু ‘ঠাই নাই’। কলাপাতা বিছিয়ে তার মাঝে মটর-পোলাও, ক্রমে মুর্গী, ততঃক্রমে সালাদ—১ম পর্ব। ২য় পর্বে পোলাও, খাসী ও সালাদ এবং পর্ব-নির্বিশেষে: ‘... হাপুস হুপুস শব্দ, চারিদিক নিঃশব্দ, পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে...’। সেই পাতা গুলি জড়ো করে এক জায়গায় ফেলার একটা আদেশ এবং নির্দেশিত স্থান ছিল, যেখানে অচিরেই বেশ কিছু কুকুর হুটোপুটি করে মোড়ানো পাতা খুলে পিপড়েদের উপর ‘রেগে কাঁই’! এই রোয়াঁ-উঠা কুকুরের মুখে অন্যায্য গালি খাবার মনোকষ্টে, পিঁপড়াদের পণ দেখেই সম্ভবত কবি লিখেছিলেন... ‘এক পিঁপড়ে অনেক চেষ্টাতে হায় শেষটাতে... বেয়ে বেয়ে উঠে সেই দেশটাতে... যেথা শুধু মধূ R মধূ’। R=Ravine
আচ্ছা ‘ওরা’ কি খেলো? আমাদের কথা একটুও মনে হয় নি? ‘ও’-ই বা কি খেলো? আরে হ্যাঁ, ঐ যে: নাদিরা যার নাম, বড় বড় চোখ, ছোট ছোট লেখায় যে বলে: ‘তোমার সকল দুখের প্রদীপ হয়ে আমিই জ্বলবো’। তবু চিনলেন না? আরে যন্ত্রণা! দু’বেনী তো এই সাড়ে-সাতকোটির দেশে একজনেরই হয়! সাবধান, এক বারের বেশী তাকাবেন না কিন্তু, কারন ‘বেতের ফলের মত’ ঐ চোখ: স্পষ্ট ও ব্যাক্ত--আশ্রয় ও প্রশ্রয়, যার আশ্রয়ে বাঘ হয় চিতা আর প্রশ্রয়ে? স্বপ্ন হয় প্রজাপতি!
শীতের দিন দীর্ঘ নয় তাই হঠাৎ করেই সন্ধ্যা এসে যেত: বেশ বিষণ্ণ ও একটু ঠাণ্ডা। লগ্ন এলো ভগ্ন করার----সেটা এক কষ্ট, তার সাথে ছট্ফটানি: ঐ বাসটাও একই সাথে ছাড়বে তো? মধুপুরে বাঘ অশ্রুত নয়, আশ্রয় পেলে চিতা হয়ে ভস্ম করতে মোটেই সময় নেবে না! সুতরাং একটু খবরদারির ভাব এসে যেতেই পারতো। তাই হঠাৎ করেই: ‘হ্যালো মাইক্রোফোন’ এর মাধ্যমে একটু ভয় ছড়িয়ে, ‘আমরা যাচ্ছি’ মার্কা একটা ভাব দুলিয়ে, ‘ও’দের ফেরত যাত্রা কে ত্বরান্বিত ও সমন্বিত করার চেষ্টা, তাতেও না কুলালে ‘চুনিয়াদের’ গলির মাথায় বসে গান গাওয়া: ‘ ...এক ঘর বানাউঙ্গা তেরে ঘর কি সাম্নে, দুনিয়া বাসাউঙ্গা তেরে ঘর কি সাম্নে ...’। যায়েগা কাঁহা?
ফেরার প্রস্তুতি অনেক: লটবহর গোছানো, অকুস্থল পরিষ্কার, কুকুরদের কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং পিঁপড়েদের কোমর জড়িয়ে একটু আদর ও সামনের বার আরেকটু উদার হবার প্রতিশ্রুতি। জংগল থেকে সংগৃহীত ‘গীলা’ গুলি পকেটে যাচাই করা, আর বুকপকেটে হাত বুলিয়ে সর্বশেষ চিঠিটার ওম্ নেয়া, যার একটি লাইন ছিল: ‘আমার সমস্ত ভালোবাসা নারকেলের মত কুঁড়িয়ে কুঁড়িয়ে তোমাকে দিলাম’। মধুপুরের কারনেই ভাষাটা দেহাতী তবে ভাবটা দেহাশ্রয়ী কারন নারকেল গোলাকার তেমনই কতকিছুই গোলাকার, এমনই এক গোল-এর বর্ণনা পাওয়া গেল আত্মজার কাছে নেলসন মেন্ডেলার লিখিত এক চিঠিতে যেখানে তিনি বলেছেন: 'মেয়েদের স্তন হবে কামানের গোলার মত'। ফলে ‘নিমিষে এ মন পিয়াসী’!
ফিরতি পথে ঠাণ্ডা ঠেকানোর জন্য বাস-এর জানালা-দরজা সবই বন্ধ, ভেতরে: ম’ধুম গান, ইত্যকার ইয়ার্কি এবং স্বধুম সিগারেট, তারসাথে সকালে খাওয়া সেদ্ধ-ডিম-উদ্ভূত-'বায়ু', যা আশা ভোশ্লের সাথে গলা মিলিয়েই যাচ্ছে:...যেতে দাও আমায় ডেকো না......। কে কাকে রোখে?
হঠাৎ কোরেই ঐ, ঐ যায়, মানে, আমাদেরকে পেছনে ফেলে চুনিয়াদের বাস এগুচ্ছে, পরাত পরাত করে বাসের জানালাগুলি হাঁটু পর্যন্ত নামিয়ে ‘হুমড়ি খেয়ে পড়লো সারি সারি’ কিন্তু ওদের সব গবাক্ষ কুলুপ এঁটে আমাদের সাথে কটাক্ষ করছে, তখন গান হচ্ছিলো...... 'শেষ প্রহরের ভীরু নয়ন ব্যথায় ছলছল, তবু তুমি নীরব কেন একটু কিছু বল...’। না, সেই অধরা বলেনি কিছুই, লিখেছে অনেক, আর বলেছে প্রজাপতির কাছে:
‘সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরেও,
আমি ভুলিবোনা’।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন