মনোনেশ দাস : বাংলাদেশে মাছের প্রাকৃতিক উৎস হিসেবে সাগর নদীর গুরুত্ব হাওর বিলের চাইতে বেশী নয়।মাছ বিশেষজ্ঞগণ এক সময় এমন অভিমতই পোষণ করতেন। হাওর বিলের মাছ দেশের আপামর জনসাধারণ সর্বজনীনভাবে ধরে থাকে। তাই হাওর বিলে মাছ ধরার রীতিনীতি একটি সামাজিক সংস্কৃতির অঙ্গও বটে। বৈশ্বিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারনে আমাদের দেশের হাওর বিলের বিলুপ্তি ঘটছে।এতে স্বাদু পানির কৈ,মাগুর,সিং,ট্যাংরা ইত্যাদি বিলজ মাছ ক্রমেই হ্রাস পাচেছ ।সাগর নদীতে যেমন সারাবছর পানি থাকে অধিকাংশ হাওর বিলে তা থাকে না। চৈত্র বৈশাখের খড়ার দিনে অধিকাংশ হাওর বিল শুকিয়ে যায়।কিন্তু বিলের একেবারের তলায় এক বা একাধিক পানিমিশ্রিত কাদামাটির গভীর খাদ থাকে।কাদা জলের এই খাদকেই স্থানীয় ভাষায় “দাম” বলে।খড়ায় বিলের চারদিকে চৌঁচির হয়ে গেলেও এই দাম পানিশূন্য হয় না।লুকিয়ে থাকা মাছগুলো তাদের গা থেকে এক ধরনের লালাবৎ পদার্থ নি:স্বরণ করে আশপাশ আর্দ্র রাখে।শীতের মধ্যদিকে বিলের পানি কমতে থাকলে মাছগুলো এই দামে শীতনিদ্রায় (হাইবারনেশন) যায় ।
খরা মৌসুমে চৌচির বিলের মধ্যখানে কাদা মিশ্রিত জলাধার একটি বিস্ময়কর ভূতাত্ত্বিক বিষয়। দামের কাদামাটিতে এক ধরনের লতানো উদ্ভিদ ঘনভাবে জন্মায়,যার জন্য সূর্যালোক ভেতরে প্রবেশ করে না।এই কাদাজলের গভীরতা তিন ফুট থেকে তিরিশ ফুট পর্যন্ত হতে দেখা যায়।লতানো উদ্ভিদ ঢাকা দামের উপরে কোন মানুষ ,গরু-ছাগল বা বন্যপ্রাণী ভূলবশত উঠে গেলে এই কাদাজলে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে ।গ্রাম-গঞ্জে দামে গরু-ছাগল হারিয়ে যাওয়ার কথা শোনা যায়।অর্থাৎ এই কাদাজল চোরাবালির মত ভয়ংকর।যাতে ওজনে ভাড়ী যে কোন প্রাণীই তলিয়ে যেতে পারে ।
সাধারণত: পাহাড়ী পাদদেশ অঞ্চলে এসব দাম সম্পন্ন বিল বেশি চোখে পড়ে ।পাহাড় বা বনাঞ্চলের পত্রঝড়া গাছের পাতা বসন্তে মাটিতে পড়ে। গ্রীষ্মে তা শুকিয়ে পচনের জন্য প্রস্তুত হয়।বর্ষার জলে এই পাতা পচে পাহাড়ী ঢ়লে হাওর বিলের তলায় গিয়ে জমে।পাতা পচা পলি বিলের কেন্দ্রবিন্দুতে এক ধরনের বালুহীন পলিরস্তর তৈরী করে।বর্ষাকালে রাতের বেলায় বিলের জলে যে ভূতের আগুন বা আলেয়ার আলো দেখাযায় তা এই পাতা পচা পলিমাটি থেকে মিশ্রিত মিথেন গ্যাস বাতাসের সংঘর্ষে জ্বলে উঠে ।ধারনা করা হয় বিলের তলার এই পলি¯তর গভীর পলিস্তর বিশিষ্ট দাম তৈরি হতে হাজার হাজার বছর লাগে ।যে সব স্থানে দাম গড়ে উঠে তার নীচে পাহাড়ী উঁচু ভূমির ঝরণা ধারার একটি মুখ্যম প্রবাহ স্থানে এসব দামের উৎপত্তি।এই ঝরণা জলের প্রবাহই দামে কাদাকে জলমগ্ন রাখে । হাওরবিলেরকৈ,মাগুর,শিং,টাকি,ট্যাংরা(ক্যট ফিস)জাতীয় মাছ এবং অন্যান্য অনেক প্রজাতির মাছ এ দামের কাদাজলে শীত নিদ্রায় কাটায়। বর্ষার নতুন জলে এসব মা মাছই পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।ভরা মৌসুমে হাওর বিলের অগুন্তি মাছের উৎস এসব মাছই । তাই হাওর বিলের মাছের জননাধার হিসেবে দামের কোন বিকল্প নেই।ইদানিং কিছু মাছ ব্যবসায়ী বালি মাটি দিয়ে এ সব দাম ভরাট করে মৎস্য খামার তৈরি করছে। যার ফলে দামের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে এসব দামের শতকরা একশ ভাগই খাস জমি।হালের সরকারী খাসজমি বিতরণ প্রকল্পের কারনে এসব দামগুলিও মালিকানায় চলে যাচ্ছে । দামের জমি আবাদী করার লক্ষে বালি বা দো-আঁশ মাটি দিয়ে এসব দাম ভরাট করে ধান চাষ করা হচ্ছে । মুক্তাগাছায়
রসুলপুর বনের পাদদেশে আবহমান কালের বড় বড় দাম যেমন; বড়িল,ধনরা,হাওদা,কাজলকোঠা,চিতল,প্রভৃতি বিলের দামগুলি ভরাট করে ধান চাষ করা হচ্ছে। তেমনি সারাদেশে সম্ভবত শতকরা ৭০ ভাগ ছোট-বড় বিলের দামগুলি ভরাট করা হয়েছে ।এটি বিলজ মাছের জন্য বিলুপ্তির পূর্বাভাষ।দাম বিষয়ে অনেক জানা অজানা কথা বিল পাড়ের গণ-মানুষের মুখে মুখে শোনা যায় ।অনেক উপাখ্যানও প্রচলিত আছে ।সগর-দিঘি,কমলা রাণীর দীঘি ইত্যাদিতে রাজকণ্যার সলিল সমাধির কথা জানা যায় ।প্রকৃতপক্ষে এসব কাহিনী দামে কোন সুন্দরী রমনীর ডুবে যাওয়ার স্মৃতির অপভ্রংশই এ সব উপাখ্যানের উৎস ।অন্যদিকে এই দামের মাটিতে হাটলে সমূহ অমঙ্গলের বার্তা সবারই জানা ।এমনই কিছু টাবু বিশ্বাস বিল পাড়ের খেটেখাওয়া মানুষদের রয়েছে । কিন্তু শিক্ষিত মৎস্য বিঞ্জানীগণ এমন টাবুর সাথে পরিচয় নাই বলেই বিলের এসব মাছকে “বাজে মাছ” বলে চিহ্নিত করেন এবং দাম ভরাট করে মৎস্য চাষের উদ্যোগ নেন। এহেন প্রকল্পগুলি বিলজ মাছের জন্য মহামারীর চাইতেও ভয়ংকর।
বিল পাড়ের মানুষের মঙ্গল-অমঙ্গলের বিশ্বাসে আবহমানকাল ধরে টিকে থাকা প্রাকৃতিক মাছের জননাধার এই দামগুলি বাস্তবতার দৃষ্টিতে মঙ্গলময় হোক এই কামনা পরিবেশবাদীদের।এ ব্যাপারে বিল পাড়ের বাসিন্দারা প্রতিবেদক মনোনেশ দাসকে জানান,এই দাম যুগ যুগ ধরে আমাদের প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদকে টিকিয়ে রেখেছে । এগুলি ধ্বংস হয়ে গেলে ছোট মাছ বাজার থেকে উধাও হয়ে যাবে । দরিদ্র লোকজন যারা অর্থাভাবে এসব মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতো,তারাও বঞ্চিত হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন