photo

রবিবার, ২৯ জুন, ২০১৪

মুক্তাগাছায় রথযাত্রা উৎসব শুরু


স্টাফ রিপোর্টার : মুক্তাগাছার ঐতিহ্যবাহী ৫৬ প্রহরমাঠে আজ রবিবার রথযাত্রা উৎসব শুরু হয়েছে । এ উপলক্ষে সকাল ১০ টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত কীর্তন পাঠ অনুষ্ঠিত হয় । বেলা ১২ টায় জগন্নাথ দেবের রথের টানে অংশ নেন ভক্তবৃন্দ । রথযাত্রা উৎসবে ৫৬ প্রহরমাঠে বসেছে লোকজ মেলা । মন্দিরের পুরোহিত নিমাই গোস্বামী ও মাঠ কমিটির সাধারণ সম্পাদক চন্দন সাহা জানান , ৯ দিন পর মহারাজা রোডস্থ রাধা গোবিন্দ মন্দির প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হবে উল্টো রথযাত্রা । জানা যায়, প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব সাড়ম্বরে পালন করা হয়। শ্রীকৃষ্ণের দ্বাপর যুগে লীলা সম্ভরণের পরবর্তীতে রথে থাকেন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা যা খর্বাকৃতি। ভক্তবৃন্দ ভক্তি সহকারে রথরজ্জুর মাধ্যমে রথকে টেনে এগিয়ে নিয়ে যান। শাস্ত্রে আছে 'রথস্থ বাম নং দৃষ্টা পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।' রথের উপরে খর্বাকৃতি বামন জগন্নাথকে দর্শন করলে তার পুনর্জন্ম হয় না। তাই রথরজ্জু ধরে রথটানা মহাপুণ্য কর্ম বলে সনাতন ধর্মে স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থ 'ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ' ও 'পদ্মপুরাণে'ও এই রথযাত্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। রথযাত্রার মূলে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব। কালের পরিক্রমায় হিন্দু সভ্যতার উত্থানকালে এ রথযাত্রা 'শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা' হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে। ওড়িশার পুরীর জগন্নাথ ধামের রথযাত্রা জগদ্বিখ্যাত। 'পুরুষোত্তম ক্ষেত্র' বা 'শ্রীক্ষেত্র' বলতে পুরীকেই বোঝায়। জ্যৈষ্ঠে স্নান-যাত্রায় ও আষাঢ়ে রথের সময় বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে পূজিত হন। চৈতন্য মহাপ্রভুই মূলত নীলাচলে ভক্তিবাদের প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অবতার। তাঁর প্রেম, ভক্তি 'সবার উপরে মানুষ সত্য'_ এসব মূলমন্ত্রই তাঁর জীবন-দর্শন। মহাপ্রভুর জীবন-দর্শন শ্রী জগন্নাথের জীবন-দ র্শন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। তাই পুরীকে বলা হয় বৈষ্ণবের ধাম। 'উৎকলখণ্ড' এবং 'দেউল তোলা' নামক ওড়িশার প্রাচীন পুঁথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল প্রায় সত্যযুগে। সে সময় আজকের ওড়িশার নাম ছিল মালবদেশ। সেই মালবদেশের অবন্তীনগরী রাজ্যে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে সূর্যবংশীয় এক পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন, যিনি ভগবান বিষ্ণুর এই জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা শুরু করার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। পরবর্তিকালে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরীর এই জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন করেন। পুরীর রথযাত্রা উৎসব হচ্ছে বড় ভাই বলরাম বা বলভদ্র ও বোন সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন যাত্রার স্মারক। তিন জনের জন্য আলাদা আলাদা তিনটি রথ। রথযাত্রা উৎসবের মূল দর্শনীয় হল এই রথ তিনটি। প্রথমে যাত্রা শুরু করে বড় ভাই বলভদ্রের রথ। এই রথের নাম তালধ্বজ। রথটির চোদ্দোটি চাকা। উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট। রথের আবরণের রঙ নীল। তারপর যাত্রা করে সুভদ্রার রথ। রথের নাম দর্পদলন। উচ্চতা প্রায় তেতাল্লিশ ফুট। এই রথের মোট বারোটি চাকা। যেহেতু রথটির ধ্বজা বা পতাকায় পদ্মচিহ্ন আঁকা রয়েছে তাই রথটিকে পদ্মধ্বজও বলা হয়ে থাকে। রথের আবরণের রঙ লাল। সবশেষে থাকে জগন্নাথদেবের রথ। রথটির নাম নন্দীঘোষ। পতাকায় কপিরাজ হনুমানের মূর্তি আঁকা রয়েছে তাই এই রথের আর একটি নাম কপিধ্বজ। রথটির উচ্চতা পঁয়তাল্লিশ ফুট। এতে ষোলোটি চাকা আছে। প্রতিটি চাকার ব্যাস সাত ফুট। রথটির আবরণের রঙ হলুদ। তিনটি রথের আবরণীর রঙ আলাদা হলেও প্রতিটি রথের উপরিভাগের রঙ লাল। পাশ্চাত্য জগতে প্রথম ভগবান জগন্নাথদেবের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় আজ থেকে ৩৬ বছর আগে ১৯৬৭ সালে আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোতে । এই সুন্দর উৎসবটির পূর্ব ইতিহাসও খুব সুন্দর এবং এর শুরুটা হয়েছিল ১৮৭০ এর দিকে । যখন ওড়িষ্যার প্রথম আইন গ্র্যাজুয়েট কেদারনাথ দত্ত যিনি সারাবিশ্বে বর্তমানে শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর নামে বিখ্যাত । পুরীর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেক্টর হয়েছিলেন । আর তখন সরকারের পক্ষ থেকে তাকে জগন্নাথ মন্দিরের আনুষাঙ্গিক দেখাশোনার ভার গ্রহনের জন্য অনুরোধ জানানো হয় । এতে তিনি খুবই খুশি হয়েছিলেন । ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ছিলেন ভগবান শ্রী চৈতন্যমহাপ্রভুর শিক্ষা ও মহিমা প্রচারের অগ্রদূত । এরপর খুব শীঘ্রই লন্ডনে রথযাত্রা পরিচিতি লাভ করে । যখন শ্রীল প্রভুপাদ এবং তার শিষ্যরা কোন নতুন স্থানে কৃষ্ণভাবনা নিয়ে আসে প্রথমে তারা সেখানে ভগবান জগন্নাথের পূজা পরিচিতি করান । ১৯৭০ এ জাপানের টোকিওতে প্রথম রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় । ১৯৭৭ পর্যন্ত শ্রীল প্রভুপাদ ব্যক্তিগতভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে লসএঞ্জেলেস, লন্ডন, শিকাগো, ফিলাডেলফিয়া, নিউইয়র্ক, নিউ জগন্নাথপুরী (সানফ্রান্সিসকো) অংশগ্রহণ করেন । ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মে ফিলাডেলফিয়াতে জগন্নাথের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হয় রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় । সেটি ছিল আমেরিকার পূর্ব উপকূলে প্রথম কোন রথযাত্রা এবং ফিলাডেলফিয়ার ভক্তগনের কাছে পরিচিতি পায় ‘নিউ নীলাচলধাম’ নামে । ১৯৭২ সালে আমষ্টারডামে জগন্নাথের বিগ্রহ প্রতিষ্টা করেন তিনি যেটি বর্তমানে বেলজিয়ামের রাধাদেশে পূজিত হচ্ছে । ১৯৭৬ সালে বিশ্বের ১০টি প্রধান শহরে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় এবং মিডিয়াসহ সরকার কর্তৃক মন্তব্য করেন যে, বিশ্বের অন্যান্য উৎসবের তুলনায় এ রথযাত্রা উৎসব সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ এবং সুব্যবস্থাকৃত । ২০০৩ সালে মেক্সিকোতে প্রথমে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় । ব্রাজিলসহ সাউথ আমেরিকার অনেক দেশে এ রথযাত্রা উদযাপিত হয় । মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশে ইস্কনের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে সেই ১৯৮০ সাল থেকে । সুইজারল্যান্ডের জুরিখে জগন্নাথের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঐ স্থান পরিচিত হয় ‘নিউ জগন্নাথ পুরী’ হিসেবে এবং নিয়মিতই সেখানে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় । স্পেনে তিনটি শহর মাদ্রিদ, বার্সেলোনা ও মালাগাতে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় । ইতালীর মিলানেও এবং অবশ্যই ভারতের বহু স্থানেও এটি অনুষ্ঠিত হয় ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন