photo

মঙ্গলবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

মুক্তাগাছায় গ্রামীণ মেলার জৌলুষ হারাচ্ছে, কুটির শিল্পে ধ্বস

 মনোনেশ দাস,মুক্তাগাছা, ১ ফেব্রুয়ারি,২০২২


হাতের নাগালে পাওয়া ওয়ানটাইম ও মেশিনে তৈরি গৃহস্থালী পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মুক্তাগাছায় পৌষ- মাঘের গ্রামীণ মেলার জৌলুষ হারিয়ে যাচ্ছে । মুক্তাগাছার গ্রামঞ্চলের অর্থনীতির ফুসফুস হিসাবে খ্যাত মেলা সংশ্লিষ্ট কুটির শিল্পের কারিগর এবং  বিপণনকারী বা এজেন্টরা অলাভজনক হওয়ায় অন্যপেশা বেছে নিচ্ছেন । মার খাচ্ছেন পেশা সংশ্লিষ্ট ব্যাবসায়ীরাও । 

কারাখানায় তৈরি গৃহস্থালী পণ্য যত্রতত্র হাতের নাগালে থাকায় এবং ক্রমবর্ধমান প্লাস্টিক সভ্যতার দাপটে বিক্রিবাটা কমে গিয়েছে গ্রামীণ কুটির শিল্পের। এর ফলে বিপন্ন হয়ে পড়েছেন অধিকাংশ কুটিরশিল্পী। পৌষ মাঘমেলার উপরে ভরসা করেই কোনও রকমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন ওই সব কুটিরশিল্পী। কারণ, ওই মেলাতেই কিছুটা বিক্রিবাটা আজও হয়। তাই সারা বছর এই মেলার দিকে তাকিয়ে থাকেন তাঁরা।

মুক্তাগাছা বিভিন্ন স্থানে মাসে মেলা বসে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তরবাহিনী মেলা, রামচন্দ্রপুর, বানার পাড়, দরগার মেলা, বাসন্তিপূজার মেলা, ছাপ্পান্ন প্রহর মাঠ মেলা, বাঁশাটির মেলা , চঙ্গের মেলা (কাশিমপুর- খেরুয়াজিন সীমান্তে) । এসব মেলা সাধারণত গ্রামীণ মেলা হিসাবে পরিচিত। এমেলা মূলত এক দিনের। তবে কোথাও একাধিক দিনও মেলা চলে।  ব্যস্ততা তুঙ্গে উঠে কুটিরশিল্পীদের। কোথাও চলছে শেষ মুহূর্তের কাজ। কোথাও বা চলছে শিল্প সামগ্রী বাঁধাছাদার প্রস্তুতি। কার্যত ঘুম নেই কুটির শিল্পীদের। এক সময় উপজেলার দুল্লা. বড়গ্রাম, তারাটি, কুমারগাতা, বাঁশাটি, মানকোন, ঘোগা, দাওগাঁও , খেরুয়াজানি ইউনিয়ন ও পৌরসভার শহরতলীতে কামার, কুমার, তাতি , ধোপা , ক্ষৌরকার প্রভৃতি সম্প্রদায়ের জীবিকা ছিল নিজেদের তৈরি শিল্পকর্ম। ওই সব শিল্পসামগ্রী বিক্রি করে ভাত-কাপড়ের সংস্থান হত। কিন্তু, প¬াস্টিক এবং যন্ত্র সভ্যতার দাপটে হারিয়ে গিয়েছে দৈনন্দিন বিক্রিবাটা। অনেকই বাপ-;াদার পেশা থেকে ছিটকে চলে গিয়েছেন অন্য পেশায়।




 

কিন্তু, পৌষ মাঘে শুরুতে তাঁদেরই অনেকে ফেরেন পুরনো পেশায়। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তৈরি করেন নানা শিল্প সামগ্রী। পয়লা মাঘ বিভিন্ন জায়গার মেলায় পসরা সাজিয়ে বসেন। শিল্পসামগ্রী বিক্রি করে বাড়তি দু’পয়সা লাভের মুখ দেখতে পান কুটির শিল্পীরা।

বাশাটি, পাহাড়পাবইজান, কাঠবওলা, কালিবাড়িসহ বিভিন্ন জায়গায় এক দিনের  মেলা বসে। ওই সব মেলায় বিক্রিবাটার জন্য আজও বেশ খানিকটা আগে থেকেই শিল্পসামগ্রী তৈরি করতে শুরু করেন কুটিরশিল্পীরা। উপজেলার রওয়ারচর , কান্দিগাও, পালপাড়ায় কুম্ভকার, কোচ সম্প্রদায়ের বাস। এক সময় ওইসব পাড়ার বাসিন্দাদের বাঁশের ঝুড়ি-কুলো, মাটির আসবাবপত্র সহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি ছিল একমাত্র জীবিকা। চাহিদা কমে যাওয়ায় পরিবারের মহিলারা টুকটাক কাজ করলেও বেশির ভাগ পুরুষই চলে গিয়েছেন অন্য পেশায়। কিন্তু মেলায় বিক্রির জন্য মাস খানেক আগে থেকে ওই সব পুরুষও ফিরেন পারিবারিক পেশায়।


কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়,মেলায় নিয়ে যাওয়ার জন্য শিল্পসামগ্রী বাঁধাছাদা করছেন। নিবারন, কানাই , সনাতন, হুরমুজ আলী. সালাম মিয়া প্রভৃতি নামের লোকজন বললেন, বেঁচা-কেনা(বিক্রিবাটা) কমে যাওয়ায় সরাই বানানো, মাটির পাত্র, বেত- বাঁশের তৈরি সামগ্রী বানানো বর্তমানে সহায়ক পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, এক দিনের মেলায় এখনও মোটামুটি বিক্রিবাটা হয় বলেই মাস খানেক আগে থেকে শিল্প সামগ্রী তৈরি করে রাখি। লাভ যাই হোক না কেন, ধারাবাহিকতার কারণে শিল্পসামগ্রী নিয়ে মেলায় যাওয়াটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে ।

শুধু কুটিরশিল্পীরা নন, মার খাচ্ছেন অন্য ব্যবসায়ীরাও। বায়োস্কোপ, সার্কাস, ম্যাজিক, বিভিন্ন খেলা  নিয়ে মেলার কটা দিন এলাকা জমজমাট হয়ে থাকত। এখন আর সেই জমাটি ভাবটা নেই। কুটিরশিল্পীদের মতো হারিয়ে গেছে ওই সব বিনোদনও।


তবু এটা সত্যি যে, আজও প্রয়োজন ফুরোয়নি মেলার। কিছু কিছু সামগ্রীর জন্য আজও গুরুত্ব হারায়নি প্রাচীন মেলার। যন্ত্র সভ্যতার যুগেও হাতা, খন্তি, ঝুড়ি, কুলা, বেলনা,দা,বটির মতো কিছু সামগ্রীর উপযুক্ত বিকল্প নেই। তাই সারা বছরের প্রয়োজনের জন্য ওই সব সামগ্রী কেনার জন্য মেলায় যেতেই হয়। গ্রামের লোকেদের মিলিত হওয়ার সবথেকে বড় জায়গা গ্রামীণ মেলা। এখানে মানুষ মেলামেশা করতে পারে। হস্তশিল্পী-সহ বিভিন্ন মানুষ নিজেদের তৈরি জিনিস বিক্রি করেন মেলায়। এই মেলাগুলি মুক্তাগাছার অর্থনীতির ফুসফুস। 

(দরগার মেলা ঘুরে ছবি তুলেছেন, এম ইদ্রিস  আলী )

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন