মনোনেশ দাস : মুক্তাগাছার শহরতলী পাড়াটঙ্গীতে একটি পুকুর পাড়ে সারিবদ্ধ নিবিড় সহজ সবুজ আকন্দ গাছের বেড়া। মুক্তাগাছাউপজেলার গড় অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামের পথে শত শত গাছে ফুটে আকন্দ ফুল। এক সময় বাংলাদেশের আনাচে -কানাচে নিরস পতিত জমিতেও যে মূল্যবান ভেষজ উদ্ভিদ দেখা যেত, অথচ এখন তা দুর্লভ। তার নাম আকন্দ বা অর্ক।
বহু রোগের নিরাময়কারী ওষুধ হিসেবে আকন্দের ব্যবহার বাংলার ঘরে ঘরে সুপরিচিত। আকন্দ গাছ ৮/১০ ফুট উঁচু হতে দেখা যায়। এ গাছের পাতায় এবং কা-ে দুধের মতো আঠা (ক্ষীর) রয়েছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, এর দুটি প্রজাতি রয়েছে- কেলোট্রপিস গাইগেনটিয়া এবং কেলোট্রপিস প্রসেরা। ওষুধ হিসেবে আকন্দের ভেষজ ব্যবহার বিষয়ে আয়ুর্বেদ ও ইউনানি চিকিৎসায় উল্লেখ রয়েছে। হাঁপানি, পেট খারাপ, অর্শ, ব্রণ, কোষ্ঠকাঠিন্য, বুকে কর্ফ, খোসপাচড়া, একজিমায় আকন্দের পাতা, কা- ও মূলের ব্যবহার রয়েছে।
ভেষজ চিকিৎসকরা জানান, উদ্ভিজ্জ ভেষজের শ্রেণি বিন্যাসে আকন্দের স্থান প্রথম সারিতে। আকন্দের গুণাগুণ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া উচিৎ। তাতে বিলুপ্তপ্রায় গাছটির কদর বাড়বে এবং সাধারণ মানুষ এটি সংরক্ষণে সচেষ্ট হবে।
জানা যায়, মুক্তাগছায় গ্রামাঞ্চলে একদা ঝিঁঝিঁ পোকা, আর শিয়াল ডাকা ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকত। ঘরের মাঝে লন্ঠনের শিখাটা শ্রাবণ রাতের দমকা হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠত । অসুস্থ শিশুদের মাথায় নেকরায় জল দেয়া হত । মধু, তাল মিছড়ি, দারুচিনির সঙ্গে বাসকপাতা ফুটিয়ে ছেঁকে নেওয়া পানীয়। মা দাদীর নির্দেশে ছোট্ট শিশুকে চিবিয়ে খেতে হদ উৎকট স্বাদ-গন্ধ যুক্ত কাঁচা নিসিন্দা পাতা। সে সময় জ্বর হলেই প্যারাসিটামল বা কাশি হলে কাফ সিরাপ এত সহজলভ্য ছিল না গ্রামের মানুষের কাছে। তারা ওষুধে এত অভ্যস্তও ছিলেন না। জ্বর-জ্বালা হলে বাড়ির আশপাশের গাছগাছালিই ছিল মানুষের সুস্থ হয়ে ওঠার মূল ভরসা। ঔষধি গুনে ভরা কালমেঘ, ঘৃতকুমারি, তেলাকুচো, পলতা, আকন্দ, বৈচি, থানকুনি, কুলেখাড়া, ব্রাহ্মি, কলমি, হ্যালেঞ্চার মতো কতশত নাম জানা, না জানা গুল্ম, বৃক্ষ, শাক গ্রামবাংলার পথঘাটে ছড়িয়েছিটিয়ে ছিল তখন।
এখন যাদের অনেকগুলোই হারিয়ে গিয়েছে বা হারিয়ে যেতে বসেছে। তাদের গুণাগুণ সম্বন্ধেও সচেতন নয় বর্তমান প্রজন্ম। এই যেমন ঘুসঘুসে জ্বরে নিসিন্দা পাতা, সর্দি কাশিতে বাসক, তুলসিপাতা তো আছেই। রক্তাল্পতায় কুলেখাড়া, বুদ্ধি বিকাশে ব্রাহ্মি, অনিদ্রায় শুষনিশাকের ব্যবহার তো অতি পরিচিত। কৃমির জন্য সাত সকালে কাঁচা কালমেঘ পাতা, আনারস পাতার রস তো মহৌষধ বলে মনে করা হয় এখনও। পেটের সমস্যায় থানকুনি পাতা, গাঁদাল পাতা ব্যবহারে ভালোফল মেলে। কেটে গেলে রক্ত বন্ধ করতে বন তুলসি, পাথর কুচি, গাঁদা বা কচার আঠা ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেওয়া— এ সব তো খুব চেনা টোটকা ছিল ছোটবেলায়।
বেশ কিছুদিন আগেও সাত সকালে নিম, কচা বা বাড়ির পাশে ঝোপ হয়ে থাকা আশশেওড়ার ডাল দিয়েই দাঁত মাজতেন গ্রামবাংলার মানুষ। ভ্যারান্ডা, জীবলি বা পলতা মাদার গাছের ডাল দিয়ে বাড়ির বেড়া দেওয়া তো খুব সাধারণ ব্যপার ছিল একটা সময়। চৈত্র মাসে টানের সময়ে সেই ডাল পুঁতলে তার থেকে সহজেই শিকড় বেরিয়ে গাছ হয়ে যেত। এখন তো জীবলি বা পলতা মাদার গাছ প্রায় চোখেই পড়ে না। জংলি গাছগুলোর মধ্যে দাদমর্দন, পলতা মাদার (পারিজাত), আকন্দ বা কেওকন্দর মতো বেশ কিছু গাছের ফুল এত সুন্দর দেখতে যে, তাদের বাহারি গাছ হিসেবেও বাড়িতে লাগানো যেতেই পারে। চাকুন্দা, দাদমর্দন গাছের রস চর্মরোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করার রেওয়াজ আছে। এমনকি, গায়ে লাগলেই গা চুলকায় যে বিছুটি গাছকে আমরা এড়িয়ে চলি সেই গাছও চর্মরোগ, প্রস্রাবের সমস্যা, মাথাব্যথা, হাঁপানিতে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
আগে রাস্তার ধারে প্রচুর হাতিশুঁড় গাছ দেখা যেত, যা চোখের সমস্যায় ও গাঁটের ব্যথায় ব্যবহার হত। গ্রামগঞ্জের রাস্তার ধারে ধারে হলুদ ফুলের কাল কাসুন্দার ঝোপ আজও চোখে পড়ে। যা কাশি, রক্তের দোষে ব্যবহার করা হয়। আগে তো বাড়িতে বেড়া দেওয়ার জন্য মেহেন্দি গাছেরও খুব কদর ছিল মেহেন্দি পাতা বেটে মহিলারা হাতে মেহেন্দি করতেন, তেমনই আবার চুল কালো করতে হাতের নাগালে পাওয়া কেশুত গাছের পাতারও যথেষ্ট ব্যবহার ছিল। সমস্যার কথা হল, চোখের সামনে আগাছার মতো বেড়ে ওঠা এই গাছগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে। গাছগুলোর হারিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ক্রমশ বেড়ে ওঠা নগর সভ্যতা, গাছগুলোকে আগাছা হিসাবে গণ্য করে তাদের ধ্বংস করা, বর্তমান প্রজন্মের তার চারপাশের প্রকৃতির প্রতি উদাসীন হওয়ার মতো বেশ কিছু কারণকেই দায়ী করছেন পরিবেশবিদেরা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন