মনোনেশ দাস : ময়মনসিংহ শহর ও জেলার উপজেলাগুলিতে উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ছটপূজা হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হয় এই পূজা ।
জানা যায়, ভারতীয় বংশদ্ভুত হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব এই ছটপূজা । পূজা উপলক্ষে ব্রহ্মপুত্র নদ, আয়মন নদী ও বিভিন্ন পুকুরে ঘাটে পূজার আয়োজন করা হয় । আয়োজকরা জানান , আটা, গুড় ও তেল দিয়ে তৈরি করা হয় পূজার প্রধান উপকরণ শিল্পকর্মে আঁকা ছাপের পিঠা । বাঙ্গলী হিন্দুদের সাথে তাল মিলিয়ে দুর্গাপূজা ও কালীপূজায় অংশ নিলেও মূলত এটি তাদের মূল সংস্কৃতির পূজা ।
এয়মনসিংহ বিভাগসহ বাংলাদেশে সামাজিক সাংস্কৃতিক বেষ্টনির মধ্যে ভারতীয় বংশোদ্ভুত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন পরিচয়,পেশা ও ভাষাভাষী অন্তজ শ্রেণীর অবস্থানটি লক্ষ্য করার মত । ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও ভাষাভাষী এই জনগোষ্ঠির বাংলাদেশে সমাগমের পেছনে লুকিয়ে আছে নানা কৌতুহল উদ্দীপক প্রেক্ষিত।
জমিদারী শাসনামলে জমিদারগণ তাদের প্রয়োজনে দক্ষ শ্রমিক, কুশলী শিল্পী, পাহারাদার, সুইপার, মালী প্রভৃতি শ্রেণীর প্রচুর লোক নিয়ে আসে উত্তরভারত ও মধ্যভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। প্রাথমিকভাবে এদের মধ্যে ভাষাগত ও সাংস্কৃতি বৈশ্যাদৃশ্য লক্ষ্য করা গেলেও সমায়ান্তরে তার সমাধানও রচিত হয়েছে। এখানে দীর্ঘকাল অবস্থানের কারণে(এখানে কাজের নিশ্চয়তা, অধিকতর সন্মানী, নানানবিধ আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা, সর্বোপরী জমিদারদের দীর্ঘমেয়াদী কাজ কখনোই নির্দিষ্ট সময়ে শেষ না হওয়া) এইসব বহিরাগত এদের অধিকাংশই মূল ভূখন্ডে ফিরে না গিয়ে স্থানীয়দের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্থায়ী আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে এবং স্থানীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে অভ্যস্থ হয়ে উঠতে পেরেছে। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে বিহার থেকে আগত বিহারী, রাজস্থানের মাড়োয়ারী, উড়িস্যার উড়িয়া এবং মধ্যভারতের বিহিকা, লাকড়িগাও, কাটিয়া ভগবানপুর প্রভৃতি অঞ্চলের হরিজন ও ঋষি সম্প্রদায়ের লোক। এদের ধর্ম, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবন, ভাষারূপ আলাদা হলেও কখনো পারস্পরিক সংঘাত বাধে না। এদের নিজস্ব ভাষা পারিবারিক জীবনে ব্যবহার করতে পারলেও তারা আর কোথাও ব্যবহার করতে পারে না। বাইরে এর যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় ভাষারূপটিও বর্তমানে তাদের পূর্ব পুরুষদের মতো নেই। ভারতের উপরোক্ত অঞ্চল ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে ঘটা করে এই ছট পূজার আয়োজন করা হয় ।
ভারতের প্রখ্যাত শৈলজানন্দ সামন্তের ‘ছট্ পূজা’ শীর্ষক গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়, ভারতবর্ষের হিন্দিভাষী হিন্দুদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পূজা ছট্ পূজা। ছট্ অর্থাৎ ছটা বা রশ্মির পূজা। এই রশ্মি সূর্য থেকেই পৃথিবীর বুকে আসে। সুতরাং এই পূজা আসলে সূর্যদেবের পূজা। প্রত্যক্ষভাবে ‘ছট;-এর পূজা হলেও এই পূজার সঙ্গে জড়িত আছেন স্বয়ং সূর্যদেব, আছেন মা গঙ্গা এবং দেবী অন্নপূর্ণা। পৌরাণিক কাহিনিতে রয়েছে , বর্ষার আগমন ঘটেছে। কিন্তু বৃষ্টি তেমন হয়নি। চাষিদের মাথায় হাত। মাঠের ফসল মাঠেই মারা যাচ্ছে। মা অন্নপূর্ণা ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকেন। সকল দেবতা মা অন্নপূর্ণার এহেন দুর্দশায় ব্যথিত। ঘরে ঘরে অন্নাভাব হাহাকার ওঠে। সূর্যের তাপ হ্রাস করে বাঁচার জন্য মা অন্নপূর্ণা সূর্যদেবের ধ্যান করতে শুরু করেন। তাতে হিতে বিপরীত হয়। সূর্যেও প্রখর ছটায় মা অন্নপূর্ণা দিন দিন শ্রীভ্রষ্টা হয়ে ক্ষীয়মান হতে থাকেন। দেবলোকে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দেবতারা সম্মিলিতভাবে সূর্যদেবের কাছে গেলে তিনি মা অন্নপূর্ণার এই দশার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। এবং বলেন, মা অন্নপূর্ণা যেন গঙ্গাদেবীর আশ্রয় নেন। সূর্যদেব আরও বলেন, অস্তগমনকালে গঙ্গাদেবীর আশ্রয়ে থেকে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে এবং সপ্তমীর উদয়কালে মা অন্নপূর্ণা গঙ্গাদেবীর আশ্রয়ে থেকে উদীয়মান ছটা বা রশ্মিকে দেখে আমার স্তব বা ১২টি নাম উচ্চারণ করলে আমার স্মরণকারীকে সমস্ত পৃথিবী অন্নে পূর্ণ হতে থাকল। মা অন্নপূর্ণা আবার তাঁর শ্রী ফিরে পান।তাই ছট্ পূজা বা ব্রত একাধারে সূর্যদেব, মা অন্নপূর্ণা ও গঙ্গাদেবীর পূজা। বিজ্ঞানসম্মতভাবে বলা যায়, গঙ্গার জলে সেচ ব্যবস্থা ঠিক থাকলে অনাবৃষ্টিতেও খেত-খামার অন্নে পূর্ণ হয় এবং স্বাভাবিকভাবে মনুষ্যসমাজে খাওয়া-পরার অভাব থাকে না। এই ব্রত পালনে সূর্যদেবের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি আমাদের জীবনে যেমন বিঘœনাশক, দুঃখনাশক, তেমনি সুখদায়ক ও অর্থ-বৈভবদায়ক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন