photo
মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট, ২০১৩
বিকল্প চিকিৎসার একটি আধুনিক ও সহজ পদ্ধতি
বিকল্প চিকিৎসা বা প্রাকৃতিক চিকিৎসার কিছু পদ্ধতি সম্পর্কে গত পর্বে আলোচনা করেছি। এ পর্বেও বলছি আরো কিছু পদ্ধতি সম্পর্কে।
রিফ্লেক্সোলজি
বিকল্প চিকিৎসার একটি আধুনিক ও সহজ পদ্ধতি রিফ্লেক্সোলজি; যা শরীরকে প্রকৃতির সাথে ছন্দময় করে রাখে। এর জন্য কোন যন্ত্রপাতি বা উপকরণ দরকার হয় না; কোন ড্রাগ বা ঔষধও লাগে না। যেকোন স্থানে, যেকোন সময়ে, যে কারও জন্য এর ব্যবহার বা প্রয়োগ সহজ ও নিরাপদ।
রিফ্লেক্সোলজির শক্তিশালী ও গভীর নিরাময় পদ্ধতি শরীরকে সুস্থ ও সতেজ করে তোলে; রোগ-ব্যাধি ও ব্যথা-বেদনা দূর করে; শারীরিক শক্তির নবায়ন করে; জীবনীশক্তি ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
রিফ্লেক্সোলজির সূত্র Healing at your finger tips by gentle pressure is key to perfect health. এর বিশেষ কৌশল বা পদ্ধতি হচ্ছে- ফিংগার প্রেশার দিয়ে শরীরের নির্ধারিত পয়েন্টে নির্ধারিত সময় ধরে rubbing, pressing, moving, hold & release করা। এ পদ্ধতিতে মেসেজ করলে কেবল নির্দিষ্ট ব্যথারই উপশম হয় না, অধিকন্তু এনার্জি লাইনের মধ্য দিয়ে সারা শরীরে নিরাময়সূচক শক্তি প্রবাহিত হয়। ফলে শরীরের যেসব অঙ্গ বা গ্ল্যান্ড বন্ধ বা ব্লক হয়ে শরীরকে অসুস্থ করে তুলেছিল, সেগুলো পুনরুজ্জীবিত হয় এবং নয়া জীবনীশক্তির সঞ্চার হয়; শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়।
মানব দেহের প্রত্যেক অর্গান, গ্ল্যান্ড ও নার্ভের মূল পরিক্রমণ পথ রয়েছে এবং এসব পথের শেষও আছে। হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে এসব পথের সংযোগ রয়েছে। সব সূক্ষ্ম যন্ত্রেই অন্তর্নিহিত এমন ব্যবস্থা থাকে, যাতে বিপদের সময় সেটি আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায় এবং বোতাম টিপলেই সেটি আবার সক্রিয় হয়; অনেকটা রেফ্রিজারেটর বা গিজারের কার্যকারিতার ন্যায়। মানব দেহের মধ্যেও সেরূপ সংযোগ ব্যবস্থা রয়েছে, যার দ্বারা অভ্যন্তরীণ যন্ত্রগুলোর রক্ষণাবেক্ষন হয় এবং প্রয়োজনে মেরামতও করা যায়।
রিফ্লেক্সোলজি পদ্ধতির জন্ম মানব দেহের নিজস্ব সংযোগ বিজ্ঞান থেকে। একে আকুপ্রেশার চিকিৎসার একটি উন্নততর সংস্করণ বলা যায়। রিফ্লেক্সোলজি পদ্ধতি অনুশীলন করে আপনি নিজেই আপনার এবং পরিজনদের চিকিৎসক হতে পারেন।
যেকোন শারীরিক অবস্থায় রিফ্লেক্সোলজি দিতে পারে চমৎকার উপশম। এই হিলিং থেরাপী জীবনের প্রতি পদক্ষেপে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন-মানোন্নয়ন, শরীরের যথার্থ প্রয়োজনীয়তা পূরণ এবং চাপমুক্ত জীবন-যাপনে সহায়তা করে। বৃদ্ধ, শিশু, শারীরিক বিকলাঙ্গ বা গর্ভবতী থেকে শুরু করে যেকোন বয়সের যেকোন অসুখ নিরাময়ে রিফ্লেক্সোলজি অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল পদ্ধতি। কর্মক্ষেত্রে ক্লান্তি ও অবসাদ দূর করতে রিফ্লেক্সোলজির গুরুত্ব অপরিসীম।
ক্যান্সার রোগীদের কষ্ট লাঘবেও রিফ্লেক্সোলজির ভূমিকা দিন দিন বাড়ছে। যুক্তরাজ্যের চ্যারিং ক্রস হসপিটাল, হ্যামারস্মিথ হসপিটাল, হারলে স্ট্রীট ক্লিনিক ও লিসটার হসপিটালের ক্যান্সার রোগীদের কমপ্লিমেন্টারি থেরাপী হিসেবে রিফ্লেক্সোলজি করানো হয়। আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটি প্রকাশিত জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ীÑ সেখানকার ক্যান্সার রোগীদের এক তৃতীয়াংশ বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে রিফ্লেক্সোলজি চর্চা করে।
আমাদের দেশে রিফ্লেক্সোলজির ধারনা ও চিকিৎসায় মানুষ এখনো অভ্যস্ত হয়নি। তবে থাইল্যান্ড থেকে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে জনাব এ কে এম আনোয়ারুল হক রিফ্লেক্সোলজি চিকিৎসা দিচ্ছেন।
রেইকি বা স্পর্শ চিকিৎসা
হাজার বছর পূর্বে যাকে বলা হত প্রাণশক্তি, আমেরিকা আজ তাকেই বলছে ইউনিভার্সাল লাইফ ফোর্স এনার্জি, রাশিয়া বলছে বায়ো প্লাসমিক এনার্জি; চীন বলছে চি; মাত্র দেড়শো বছর আগে জাপানে তার নাম হয় রেইকি।
রেই-কি (জবর-শর) জাপানী শব্দ; ‘রেই’ অর্থ বিশ্বব্রহ্মান্ড; ‘কি’ অর্থ জীবনীশক্তি। অর্থাৎ রেইকি হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মান্ডের জীবনীশক্তি তথা মহাজাগতিক শক্তি।
এই পৃথিবীতে সবল ও সুস্থ দেহ নিয়ে বাঁচার জন্য যে জীবনীশক্তি আমরা প্রতিনিয়ত বিনামূল্যে পাচ্ছি, তা আসছে প্রাকৃতিক ৩টি উৎস থেকে- সূর্যরশ্মি, মুক্ত বায়ু ও মাটি। এ তিন শক্তির মধ্যে প্রধান হল সূর্যরশ্মি তথা সোলার এনার্জি। পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে পড়া সূর্যের প্রাণশক্তিকে মানব দেহের অসুস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে প্রবেশ করিয়ে তাকে সুস্থ করে তোলার প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি পুনরুদ্ধার করেছেন আধুনিক রেইকির প্রবর্তক জাপানের ড. মিকাও উসুই।
মানবদেহে রয়েছে সাতটি চক্র- ক্রাউন চক্র, থার্ড আই চক্র, থ্রোট চক্র, হার্ট চক্র, সোলার প্লেক্সাস চক্র, স্যাক্রাল চক্র, রুট চক্র। এই প্রত্যেকটি চক্র শরীরের একেকটি এন্ডোক্রিন গ্ল্যান্ডের সঙ্গে সংযুক্ত। রেইকির কাজ হল বিশ্বব্রহ্মান্ডের বিশাল শক্তিকে শরীরের চ্যানেলের মধ্য দিয়ে আবাহন করিয়ে চক্রের মধ্যে প্রবাহিত করা। চক্র থেকে শক্তি সঞ্চালিত হয় এন্ডোক্রিন গ্ল্যান্ডে। প্রথম তিনটি চক্র হল আধ্যাত্মিক চক্র, শেষ তিনটি চক্রের যোগাযোগ পৃথিবীর সঙ্গে। সোলার প্লেক্সাস চক্রটি যুক্ত আমাদের হার্ট বা হৃদয়ের সঙ্গে। পৃথিবী থেকে শক্তি আহরণ করে আধ্যাত্মিক চক্র থেকে তা প্রবাহিত হয় হার্টে। রেইকি মতে, হার্টের এক্সটেনশন হচ্ছে হাত। কাজেই ব্রহ্মান্ড থেকে আহরিত শক্তি গিয়ে জমা হয় হাতের দশটি আঙুলের প্রান্তে। বেড়ে যায় আঙুলের শক্তি, যে শক্তি দিয়ে আরোগ্য হয় রোগের।
সূর্যরশ্মি বা মহাজাগতিক শক্তিকে আহরণ করে দু’হাতের মাধ্যমে তা ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের শরীরে পৌঁছে দেয়ার মানেই হল প্রাণশক্তি প্রদান অথবা ট্রান্সফার অব লাইফ ফোর্স এনার্জি তথা রেইকি। যুগ যুগ ধরে মহামানবগণ শুধুমাত্র হাতের স্পর্শেই জরাগ্রস্ত ও ব্যাধিগ্রস্ত মানুষকে নিরাময় করে এসেছেন। এতে কোন যাদুমন্ত্রের ব্যাপার বা বিষয় নেই; বরং রয়েছে বিশেষ মানুষের বিশেষ জ্ঞান তথা বিজ্ঞান।
রেইকি বা স্পর্শ চিকিৎসার মাধ্যমে নিজেই নিজের চিকিৎসক হওয়া যায়। সামান্য কাশি থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত বিনা ওষুধে, বিনা অস্ত্রোপচারে কেবলমাত্র হাতের স্পর্শ দিয়ে নিরাময় করা যায়।
যেকোন পরিস্থিতিতে, যেকোন স্থানে, যেকোন সময়ে রেইকি শক্তি প্রয়োগ করা সম্ভব। তবে ভোর চারটা থেকে ছ’টার মধ্যে করলে বেশি কার্যকর হয়। এ সময় ইউনিভার্স থেকে একটা বিশেষ রশ্মি পৃথিবীতে আসে, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এ রশ্মির হিলিং পাওয়ার অনেক বেশি।
কোন আকস্মিক দুর্ঘটনায় রেইকি হতে পারে ফার্স্ট এইড। সাধারণ অসুখের ক্ষেত্রে ৩ দিনের রেইকি চিকিৎসা যথেষ্ট। কঠিন রোগে চিকিৎসা করতে হয় ২১ দিন।
একজন রেইকি মাস্টার নিজের শরীরে কসমিক এনার্জি এবজর্ব করেন তার শরীরের বিভিন্ন এন্ডোক্রিন গ্রন্থির মাধ্যমে। এই এনার্জি হাতের মাধ্যমে বাহিত হয় অন্যের শরীরে বা বস্তুতে। রেইকি এনার্জি আপন গতিতে চলে। হয়তো শরীরের যে সমস্যার জন্য রেইকি করা হচ্ছে, তারচে’ বড় সমস্যা ঐ শরীরে আছে। তখন কসমিক এনার্জি বড় সমস্যার স্থানেই চলে যায়। বড় সমস্যার সমাধান শেষে অন্যান্য ছোট সমস্যার সমাধান করে। এ কারণে রেইকিকে বলা হয় স্বয়ংসম্পূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি।
রেইকি হল সেøা বাট স্টিডি চিকিৎসা পদ্ধতি; এটি কোন ম্যাজিক নয়, বরং সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান। অন্যান্য চিকিৎসার পাশাপাশি রেইকি করলে রোগীর মানসিক ও শারীরিক কষ্ট দূর হয়। তাছাড়া এতে শরীর রেসপন্সও করে বেশি। অর্থাৎ রেইকি পরোক্ষভাবে চিকিৎসা পন্থার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এজন্যই বর্তমানে রেইকি মাস্টাররা হাসপাতালের আইসিইউতেও প্রবেশের অনুমতি পেয়ে থাকে।
মানবদেহের এনার্জি চক্র থেকে এন্ডোক্রিন গ্ল্যান্ড পর্যন্ত যোগাযোগে যখন বিঘ্ন ঘটে, তখনই শরীরে সমস্যা দেখা দেয়। আর এই বিঘœতার কারণ আমাদের নেগেটিভ এটিচিউড, নেগেটিভ ফিলিংস এবং কনফিউশন -এগুলোই বাধা তৈরি করে। এগুলো থেকেই খাওয়া-দাওয়া ও জীবন-যাপনে নেগেটিভ এনার্জি চলে আসে, দেখা দেয় রোগ-শোক। সাধারণত রোগের লক্ষণ শরীরে থাকলেও এর মূল উৎস মনে। যেমন- আর্থারাইটিসের কারণ মনের মধ্যে ভালবাসা না পাওয়ার যন্ত্রণা, এজমার কারণ মনের মধ্যে বদ্ধতা ইত্যাদি। রেইকি মনের এই নেগেটিভ কারণগুলো দূর করে, ফলে রোগ সেরে যায়।
রেইকির প্রধান সূত্র হল- কুচিন্তা ত্যাগ করে নিরন্তর শুভচিন্তা নিয়ে জীবন-যাপন। দীর্ঘদিনের নেগেটিভ চিন্তা আমাদের শরীরে এনার্জি গ্রহণের প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়। নেগেটিভ চিন্তার বদলে পজিটিভ এনার্জির প্রতিনিয়ত ব্যবহারই খুলে দিতে পারে শরীরে কসমিক এনার্জি গ্রহণের সবক’টি দ্বার। রেইকি পজিটিভ এনার্জি বলে মনের ওপর এর প্রভাব অপরিসীম। এতে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। সে সবকিছু পজিটিভ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। রেইকি চিকিৎসায় শেখানো হয়-
১। আজকের জন্য আমি এই নিখিল বিশ্বের কাছ থেকে যা পেয়েছি, তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব;
২। আজকের জন্য আমি কোন দুঃশ্চিন্তা করব না;
৩। আজকের জন্য আমি মোটেই রাগ করব না;
৪। আজকের জন্য আমি প্রতিটি কাজ সৎভাবে করব;
৫। আজকের জন্য আমি প্রতিটি প্রাণীর প্রতি ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন করব।
রেইকির মাধ্যমে এজমা, আর্থারাইটিস, এলার্জি, আলসার, ডায়াবেটিস থেকে শুরু করে যেকোন ক্রনিক রোগ সারানো যায়। রেইকি চিকিৎসা নিতে শারীরিক কোন প্রস্তুতির প্রয়োজন নেই। তবে মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে, কারণ এতে মাইন্ড কনসেনট্রেশন করতে হয়। রেইকি মাস্টারের মাধ্যমে সোলার এনার্জি গ্রহণের আস্থা বা বিশ্বাস এখানে জরুরি বিষয়।
যেকোন এডিকশন বা আসক্তি ছাড়াতে, বাচ্চাদের পড়াশোনায় মনোযোগী করতে, সম্পর্ক উন্নয়নে, ওজন কমাতে রেইকি চমৎকার ফল দেয়। রেইকি মন ও শরীরের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। শরীর ও মনের ভারসাম্য থাকলে শরীরে অসুখ বাসা বাঁধতে পারে না।
খাবারের ওপরও রেইকি করা যায়। এতে খাবারের পুষ্টিগুণ বাড়ে। রেইকির শক্তি খাবারের ক্ষতিকর উপাদান মুছে ফেলে। তাই রেইকি করলে খাবার হজম হয় ভাল।
রেইকি চিকিৎসা গ্রহণের সময় এমন খাবার খাওয়া উচিত নয়, যা খেলে শরীরে টক্সিন জমে। যেমন- চা, কফি, সিগারেট, এলকোহল প্রভৃতি। বরং কাঁচা বা সেদ্ধ সব্জি ও ফল খাওয়া উচিত। কারণ এগুলোর ‘র’ এনজাইম শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। তাছাড়া এ সময় প্রচুর পানি পান করা উচিত।
বাংলাদেশে রেইকি চিকিৎসার অগ্রণী ব্যক্তিত্ব ডাঃ ফজলুর রহমান শান্তিনগরে কসমিক ফাউন্ডেশন চেম্বারে রেইকি চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
এপিথেরাপী বা মৌ-চিকিৎসা
চিকিৎসা ক্ষেত্রে মৌমাছি এবং মৌচাক থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন ভেষজ উপাদান ব্যবহারের ঐতিহ্য অতি প্রাচীন। পবিত্র কোরআন শরীফে বলা হয়েছে- চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্য জ্ঞানের নিদর্শন রয়েছে মধু ও মৌমাছির মধ্যে। বাইবেলে মৌমাছি ও মধু সম্পর্কে ৬০ বার উল্লেখ রয়েছে। সনাতন ধর্মশাস্ত্রে মৌমাছিকে দেবতার সহচর বলা হয়েছে এবং দেবতা বিষ্ণুকে পদ্মফুলের ওপর বসা একটি ছোট মৌমাছি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
মৌমাছি ও মৌচাক ব্যবহারের একটি স্বতন্ত্র চিকিৎসা পদ্ধতি বর্তমানে চালু হয়েছে, যা এপিথেরাপী নামে পরিচিত। অর্থাৎ এপিথেরাপী হল মৌ-চিকিৎসা তথা মৌমাছি দিয়ে অসুস্থতা দূরীকরণ পদ্ধতি।
Apitherapy simply depends on the use of bee products to prevent, heal or recover somebody from one or more diseases. it is also the art & science of treatment and holistic healing through the honey bee & her products for the benefit of mankind and all the animal kingdom.
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সকল দেশে এপিথেরাপী চিকিৎসা চালু হয়েছে এবং এ সম্পর্কে গবেষণাও চলছে। এপিথেরাপীর ইতিবাচক কার্যকারিতার কারণে এর প্রসার দিন দিন বাড়ছে এবং বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যৌক্তিকভাবে উন্মোচিত হচ্ছে। বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় যে বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন রোগ-ব্যাধির সৃষ্টি হচ্ছে, তার নিরাময়ের ক্ষেত্রে এপিথেরাপী একটি উৎকৃষ্ট চিকিৎসা হতে পারে বলে বিজ্ঞজনেরা মনে করছেন। এপিথেরাপীর মাধ্যমে মানব শরীরের ৫০০ রকমের রোগ-ব্যাধি থেকে নিরাময় সম্ভব।
বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এপিথেরাপী একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি। কারণ এর মাধ্যমে স্বল্প খরচে অনেক জটিল রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে এই চিকিৎসা পদ্ধতি প্রবর্তন করাও সহজ।
এপিথেরাপী চিকিৎসা পদ্ধতিতে মৌমাছির যেসব উপাদান ব্যবহৃত হয়, তা নিম্নরূপ।
১। মধুঃ রোগ প্রতিরোধের সকল উপাদান বিদ্যমান মধুতে। প্রতিফোঁটা মধুতে পটাসিয়াম, সোডিয়াম, ফসফেট, কপার, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন (এ, বি ১, বি ২, বি ৩, সি, ডি) ছাড়াও গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজ বিদ্যমান।
মধু সর্দি-কাশি, টাইফয়েড, জ্বর, নিউমোনিয়া, অম্ল, কোষ্ঠকাঠিন্য ও আমাশয়ে উপকারী। মধুতে রয়েছে ত্বক ও চুলের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন, ময়শ্চারাইজিং ও এন্টিবায়োটিক গুণাবলীযার কারণে সৌন্দর্য চর্চায়ও মধু ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসক ও দার্শনিক ইবনে সিনা তাঁর ‘কানোন’ গ্রন্থে মধু দিয়ে অসংখ্য রোগের ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন।
মধুর ব্যবহার ও গুণাগুণ সম্পর্কে এ কলামের ৪১ নং অধ্যায়েও বিস্তারিত বলা হয়েছে।
২। বী ভেনম বা মৌমাছির হুলের বিষঃ মৌমাছির হুলের বিষে বিভিন্ন ধরনের উপকারী এনজাইম, পেপটাইড্স, বায়োজেনিক এমাইডসহ ১৮ ধরনের উপাদান রয়েছে; যা মানব দেহের বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। মানুষের হাঁটু ও বিভিন্ন জয়েন্টে আর্থারাইটিস ব্যথা, ক্যান্সার, টিউমার এবং ত্বকের দীর্ঘমেয়াদী রোগ নিরাময়ে এই বিষ সাফল্যের সাথে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমানে ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশে এ সকল রোগের চিকিৎসায় মৌমাছির হুলের বিষ সাফল্যজনকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা সেখানে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ও অনুমোদিত।
বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এখনও এ চিকিৎসা শুরু হয়নি। তবে অভিজ্ঞ মৌচাষীগণ হাঁটুতে ব্যথা নিরাময়ে হুলের বিষ ব্যবহার করছেন। ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে বিকীপার্স কো-অপারেটিভ্স এসোসিয়েশনের সভাপতি ও বিআইএ’র অভিজ্ঞ মৌচাষী নুরুল হক মাস্টার তার গ্রামের লোকজনের হাঁটুর ব্যথা নিরাময়ে জীবন্ত মৌমাছির হুল প্রয়োগ করেন। এতে অধিকাংশেরই হাঁটুর ব্যথা নিরাময় হচ্ছে।
৩। রয়েল জেলীঃ এটি রানী মৌমাছির নিয়মিত খাবার। রয়েল জেলী এতই পুষ্টিসমৃদ্ধ যে, মৌমাছির একটি সাধারণ ডিমে নার্স বী কর্তৃক তা নিয়মিত প্রয়োগের ফলে উক্ত ডিম থেকে একটি সাধারণ মৌমাছি না হয়ে রানী মৌমাছিতে পরিণত হয় বা জন্মলাভ করে। জন্মের ২৫-৩০ দিন পর থেকেই সে রানী মৌমাছি প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৫০০০টি ডিম পাড়ে।
মানবদেহের বিভিন্ন ধরনের রোগ-ব্যাধি নিরাময়ে এবং পুষ্টিহীনতা দূরীকরণে রয়েল জেলী ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শারীরিক দুর্বলতা, দীর্ঘমেয়াদী ক্লান্তি রোধে; প্রজনন অক্ষমতা (ফার্টিলিটি) বৃদ্ধিকল্পে; ত্বক-চুল ও নখের রোগ নিরাময়ে; সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে; রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে; এজমা ও হরমোন নিয়ন্ত্রণে; কোলেস্টেরল, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হতাশা দূরীকরণে; লিভার ফাংশন নিয়ন্ত্রণে রয়েল জেলী প্রাচীন যুগ থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
৪। পোলেনঃ শ্রমিক মৌমাছি কর্তৃক সংগৃহীত পরাগরেণুর সমষ্টিকে পোলেন বলে। এটি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার। পৃথকভাবে বা মধুর সঙ্গে মিশ্রিত করে বী-ব্রেড তৈরি করা হয়, যা ক্যান্সার ও এজমা রোগ চিকিৎসায় এবং কসমেটিক্স তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। পোলেনকে বি কমপ্লেক্স সমৃদ্ধ মাল্টি ভিটামিন ও মাল্টি মিনারেল সাপ্লিমেন্ট বলা যায়। এলার্জিজাতীয় রোগের প্রতিষেধক টিকা হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হয়।
৫। প্রপলিসঃ শ্রমিক মৌমাছি বিভিন্ন ফুলের কুঁড়ি, কচি ডাল ও গাছের আঠালো কষ থেকে প্রপলিস বা মৌআঠা সংগ্রহ করে তা মৌচাকের আশেপাশে সঞ্চয় করে রাখে। এর দ্বারা মৌমাছি মূলতঃ চাকের ফাটল জোড়া লাগায়, মৌচাককে স্থায়ীভাবে কোন কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখে এবং বায়ু চলাচল ও রোগজীবাণু থেকে কলোনী রক্ষা করে। এটি টারপিন, ভলাটাইল অয়েল, বালসাম ও মোমের সমন্বয়ে গঠিত বলে এর রোগ-জীবাণু বিধ্বংসী ক্ষমতা অনেক। সাধারণতঃ ঠান্ডা, গলা ব্যথা, চর্ম ও দন্তরোগ, আগুনে পোড়া ঘা শুকাতে, এজমা ও পাকস্থলীর হজমশক্তি বৃদ্ধিতে প্রপলিস ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও এটি ছত্রাকনাশক ও জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৬। মোমঃ শ্রমিক মৌমাছির বিশেষ গ্রন্থির সাহায্যে মধু থেকে মোম তৈরি হয়। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদার্থ হওয়ার কারণে যেকোন প্রসাধন সামগ্রী উৎপাদনে মোম ঔষধ ধারক ও বাহক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৭। এপিনার্লিনঃ মৌমাছির ডিমের এক্সট্রেনাক্টকে এপিনার্লিন বলে। বর্তমানে এটি নিয়ে গবেষণা চলছে। আশা করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে মৌমাছির বিভিন্ন উপাদানের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে এইড্স নিরাময়ের গুরুত্বপূর্ণ পথ্য আবিষ্কার করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে এপিথেরাপী চিকিৎসার উদগাতা জনাব আবদুর রাজ্জাক; ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় নিজস্ব খামারে ৩০ বছর ধরে এপিথেরাপীর ওপর গবেষণা করছেন এবং চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি এবং তার মিশন সহকারী আবিদ হোসেন, খায়রুল বাশারসহ অনেকে এ চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যান্সারসহ বহু দূরারোগ্য ব্যাধি নিরাময়ে সাফল্য দেখিয়েছেন।
আমার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ক্যাম্পাস’র স্বাস্থ্য সচেতনতা কর্মসূচির অধীনে নিয়মিত আয়োজিত হয় রিফ্লেক্সোলজি, রেইকি ও এপিথেরাপি বিষয়ক ওয়ার্কশপ এবং সেমিনার। প্রাকৃতিক চর্চার এ সেশনসমূহে নিখরচায় অংশগ্রহণে আগ্রহীদেরকে ক্যাম্পাস কার্যালয়ে যোগাযোগের অনুরোধ রইল।
-চলবে
[পরবর্তী কলামে থাকছে- অটোসাজেশন; মেডিটেশন ও মাইন্ড কন্ট্রোল; মেডিটেশনে হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ; হারবাল চিকিৎসা; রোগ তাড়াবে শীতের সব্জি; পেঁয়াজঃ ঝাঁজ হলেও উপকারী; দৈনিক ৩টি কলায় স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে; ওয়াটার থেরাপির মাধ্যমে রোগ নিরাময়; হোমিওপ্যাথি; এলোপ্যাথি, নিম্নমানের ওষুধঃ জীবন নিয়ে জুয়া; ডাক্তার নির্বাচনে সতর্কতা প্রয়োজন; ঝাড়–দার যখন ডাক্তার; অস্ত্রোপচার ছাড়াই একসঙ্গে চার শিশুর জন্ম; চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাফল্য; পরীক্ষা বলে দেবে সিজারিয়ান লাগবে কি না; উড়োজাহাজের টয়লেটে নবজাতক; মাতৃত্ব; নারীর অতি সুখের সময়; রক্ত পরীক্ষায় জানা যাবে আয়ু; স্মৃতি বাড়াতে ও সুস্থ থাকতে সংগীত; ফিরে পাবেন সব স্মৃতি; প্রেমঃ শারীরিক কষ্ট ভুলতে অব্যর্থ দাওয়াই; ভালবাসায় এলার্জি; পুরুষের কয়েকটি স্বাস্থ্য সমস্যা; বিশেষ মানুষ হওয়া ও শতায়ু লাভের অন্যান্য উপায়; সুস্থ থাকার জন্য ক্যাম্পাস’র ৬টি মন্ত্র; পশু কোরবানীর পূর্বে কু-অভ্যাসের কোরবানী দিনঃ চিন্তার দারিদ্র্য দূর করুন; নেতিবাচক কথা ও চিন্তা থেকে দূরে থাকুন; রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখা, অযথা ক্ষেপে যাবেন না; ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব সংঘাত ও স্বাস্থ্যহানি; কথায় ও আচরণে ব্যালেন্সড্ হোন; মনোরোগে শরীর ব্যথা; মানবিক হোন; সহজ সরল এবং স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন মনের অধিকারী হোন; প্রোএকটিভ এটিচিউড ও হাসির মাধ্যমে স্বাস্থ্যজয় ও বিশ্বজয়; হাসিঃ রোগ প্রতিরোধ ও দীর্ঘজীবনের টনিক; হাসিতে যত সুখ; হাসিতে আয়ও বাড়ে; অন্যকে সাহায্য করতে থাকুন- আপনার সমস্যাও কেটে যাবে; বয়স ষাটের পর করণীয়; বাধর্ক্য জয়ের টিপ্্স; অতি সুখে আয়ু কমে; সুখের রাজ্যে আত্মহত্যা বেশি; ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিঃ জীবনের প্রশান্তি]
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন