মনোনেশ দাস : এক সময় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা , ফুলবাড়িয়া , জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলার একাংশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আঞ্চলিক বৈসাদৃশ্য খেলার নাম “ হুমগুটি”। হয়তো এ খেলার কারনেই অত্রাঞ্চলের কৃষ্টি-সংস্কৃতি, আচার অনুষ্ঠান, খাওয়া-দাওয়া,খেলাধূলায় আঞ্চলিক বৈসাদৃশ্য লক্ষণীয়। খেলার ক্ষেত্রে দেখা যায়, হয়তো বাংলাদেশে এমন একটি জনপ্রিয় খেলা রয়েছে,যেমন চট্রগ্রামের জব্বারের বলী খেলা যার সম্বন্ধে অন্য অঞ্চলের কোন ধারণা নেই। হমগুটি খেলাটি বছরব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় না। সাধাররণত ফাল্গুনে আমন ধান ও তৎপরবর্তী রবিশস্য তোলার পর চৈত্রের শেষে অথবা প্রথমে ফসলবিহীন দিগন্ত বি¯তৃর্ণ খোলা প্রান্তরে এ খেলা জমে উঠে । প্রধানত গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া কৃষাণ পরিবার সুস্থ্য , সবল, সাহসী যুবক থেকে শুরু করে প্রাকপ্রবীণ বযসীরাই এ খেলায় অংশ গ্রহন করে। খেলায় থাকে একটি মাত্র অদ্ভুদ উপকরণ । বৃহদাকার পিতলের কলসির গলার নিচের গোলাকার যে অংশ ঠিক সেরকমের একটি অংশের ভিতরে এমনভাবে মাটি ঠেসে ভরা হয় যে, মুখ বন্ধের পর তাতে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েও মাটি বের করা যায় না। ওজন প্রায় এক কেজি। খেলার পক্ষ দু’টি এবং ভিন্ন দুটি গামের । খেলোয়াড়ের সংখ্যা সামান্য দু” একজন হেরফের হলেও তেমন অসুবিধা মনে হয় না। প্রতিযোগী দুই গ্রামের সমদূরত্বে অবস্থিত একাধিক গ্রাম অতিক্রম করে তৃতীয় একটি গ্রামের নির্দিষ্ট জায়গায় হুমগুটি রাখা হয়।উভয় দলের মনোনীত নেতার নির্দেশ পাওয়া মাত্র শুরু হয় খেলা হুমগুটি। গুটি নিয়ে দু দলের কাড়াকাড়ি,আপন আপন গ্রাম নিয়ে যাওয়ার জন্য। যারা নিয়ে যেতে পারবে তারাই হবে বিজয়ী। খেলাতো নয় যেন ঢাল-তলোয়ার,হাতী-ঘোড়া বিহীন যুদ্ধ। একেক জন জীবনপন করে কাড়াকাড়ি করে। কিন্তু নেতাদের নেই কাম-ক্রোধ,হিংসা-প্রতিহিংসা,দ্বেষ-বিদ্বেষ,থাকে প্রতিযোগীতা। কেবলই প্রাণবন্ত ও চিত্তাকর্ষক নির্মল প্রতিযোগীতা আর আঞ্চলিক ঐতিহ্য রক্ষার নিরন্তর প্রয়াস। এক পক্ষ ১শ” গজ টেনে নিয়ে গেলে , আবার অপর পক্ষ নিয়ে গেল দুইশ” গজ। সে এক অপূর্ব মনকাড়া দৃশ্য। একটি গুটির উপর পরস্পর বিরোধী বহু সংখ্যক হাত পড়ছে , কিন্তু নিয়ম ভেঙ্গে কেউ কাউকে আঘাত করছে না। বিরল অভিজ্ঞতা । এই যে নিয়ম মেনে চলা তা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বা সংবিধান রচনা করে শেখাতে হয় না। অক্ষর জ্ঞানহীন র্কষাণ প্রতিযোগীরা প্রচলিত নিয়মনীতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই তা ধাতস্ত করে। খেলা কিন্তু এক দিনে শেষ হয় না। হয়তো দু”চারদিন দিন রাত চলে চলে এই কাড়াকাড়ি। যেন “বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচাগ্র মেদিনী” এমন একটা জেদাজেদি। প্রতিযোগীদের চারদিকে স্ব স্ব গ্রামের উৎসাহীগণ ঘেরাও করে হাততালি দিয়ে নিয়ে যায় এবং সঙ্গে যোগ দেয় পথিমধ্যকার গ্রামবাসী। হাজার হাজার ক্রীড়ামোদি পিপড়ার সারির মত সহগামী হয়। অবাক হওয়ার মত ঘটনা হলো, প্রতিযোগী ছাড়াও ভূলেও অন্য কেউ গুটি স্পর্শ করে না।এ এক অপূর্ব শৃঙ্খলাবোধ। খেলা চলাকালিন অংশগ্রহনকারীদের আপ্রায়নের দায়িত্ব নেয় চলার পথের গ্রামের স্বচ্ছল পরিবারবর্গ । অনেক অস্বচ্ছল পরিবারের সদস্যরাও একত্রিত হয়ে শখ করে এদের অপ্যায়নের ব্যবস্থা করে। এ তাদের গৌরবের বিষয়। খাবার সময় হলে গুটি মাঝখানে রেখে প্রতিযোগীরা গোল হয়ে বসে খাবার সারে । চলার পথে ফলন্ত গাছের ফল সাবার করতে কারো অনুমোতির প্রয়োজন পড়ে না। যেন ফলগুলো তাদের জন্যই উৎসগিৃত। এটাই নিয়ম। গ্রামের পর গ্রাম ভেঙ্গে গুটি নিয়ে নিজ গ্রামের সীমানার ভেতর প্রবেশ করার সাথে সাথে খেলার সমাপ্তি। বিজয়ী দল গুটি নিয়ে গ্রামের ধনাঢ্য বাড়ি গিয়ে উঠে। নানা উপঢৌকন এবং ভুরিভোজনে আপ্যায়ন করে তাদের বরণ করা হয়। চলমান বছর শেষ না হওয়া পর্যন্ত হুমগুটি বরণকারীর বাড়িতেই রক্ষিত থাকে। আধুনিক বিজ্ঞান কৃষি ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে,তার ফলে এখন আর ফসলহীন বিস্তিৃণ খোলা প্রান্তর কমে যাওয়ায় হুমগুটি খেলা বিলুপ্ত হতে চলেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন