পৃষ্ঠাসমূহ

বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০১৯

মুক্তাগাছার জমিদারদের স্থাপনা ময়মনসিংহে


ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক আলেকজান্ডার ক্যাসেলের ইতিহাস সমৃদ্ধ সাইনবোর্ডটি কে বা কারা মুছে ফেলেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সরেজমিনে এ দৃশ্য দেখা গেছে। পাশে লোহার কুঠি নামে খ্যাত ভবনটির বেহাল দশা। ভবনটি দেখতে এসে পর্যটকরা বিস্ময় প্রকাশ করছেন। জানা গেছে, উনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত হয় আলেকজান্ডার ক্যাসেল। ১৮৭৯ সালে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী এটি নির্মাণ করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে যার ব্যয় হয়েছিল ৪৫ হাজার টাকা। তখন ভবনটির চারপাশে ছিল দীঘি ও বাগান। ভবন নির্মাণে লোহা ব্যবহার বেশি হয়েছিল বলে ‘লোহার কুঠি’ নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে এটি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের গ্রন্থাগার হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ময়মনসিংহ সফরকালে আলেকজান্ডার ক্যাসেলে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন। এছাড়াও দেশ-বিদেশের বরেণ্য লর্ড কার্জন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ, কামাল পাশা প্রমুখ এ ভবনে অবস্থান করেন। ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, মুক্তাগাছার জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ আচার্য চৌধুরীর তৃতীয় উত্তরপুরুষ রঘুনন্দন আচার্য চৌধুরী নিঃসন্তান ছিলেন। অথচ পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী, সম্পত্তি সংরক্ষণে সক্ষম একটি পুত্রসন্তান ভীষণভাবে প্রয়োজন। তাই দত্তক পুত্র গ্রহণের সিদ্ধান্তে উপনীত হন। গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীকে দত্তক নিলেন রঘুনন্দন। মৃত্যুর আগে দত্তক পুত্রের হাতে জমিদারির ভার অর্পণ করেন। জমিদার গৌরীকান্ত আচার্য চৌধুরীর প্রতিও সদয় ছিল না নিয়তি। সন্তানহীন অবস্থায় অকালপ্রয়াণ ঘটল তারও। গৌরীকান্তের বিধবা পত্নী বিমলা দেবী দত্তক নিলেন কাশীকান্তকে। কাশীকান্তের কপালও মন্দ ছিল ভীষণ। দীর্ঘ রোগযন্ত্রণায় ভুগে সন্তানহীন অবস্থায় পরলোকগমন করলেন তিনিও। তার বিধবা পত্নী লক্ষ্মী দেবী আচার্য চৌধুরানী পূর্বসূরীদের পথ অনুসরণ করে দত্তক নিলেন চন্ত্রকান্ত আচার্য চৌধুরীকে। ভাগ্যের বিরুদ্ধাচরণে চন্দ্রকান্তও অতিদ্রুত ত্যাগ করলেন পৃথিবীর মায়া। তবে হাল ছাড়লেন না লক্ষ্মী দেবী। আবার দত্তক নিলেন তিনি। দ্বিতীয় দত্তক পুত্রের পূর্বনাম পূর্ণচন্দ্র মজুমদার। কুলগুরুর সামনে মহাসমারোহে লক্ষ্মী দেবী নতুন নাম রাখলেন পুত্রের সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীর শাসনামলে ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী জনপদে যুক্ত হলো সোনালি মাত্রা। প্রায় ৪১ বছর জমিদারি পরিচালনার প্রশস্ত প্রেক্ষাপটে বহু জনহিতকর কাজ করলেন তিনি। ময়মনসিংহে স্থাপন করলেন একাধিক নান্দনিক স্থাপনা। ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে নয় একর ভূমির ওপর একটি অসাধারণ দ্বিতল ভবন নির্মাণ করলেন সূর্যকান্ত। নিঃসন্তান সূর্যকান্তের দত্তক পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীর নামে এই ভবনের নাম রাখা হলো শশী লজ। বিখ্যাত এই ভবনটি ১৮৯৭ সালের ১২ জুন গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে অত্যন্ত ব্যথিত হন সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৯০৫ সালে ঠিক একই স্থানে নতুনভাবে শশী লজ নির্মাণ করেন পরবর্তী জমিদার শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী। ১৯১১ সালে শশী লজের সৌন্দর্যবর্ধনে তিনি সম্পন্ন করেন আরও কিছু সংস্কারকাজ। নবীন জমিদারের প্রাণান্ত প্রায়াসে শশী লজ হয়ে ওঠে অনিন্দ্যসুন্দর, অপরূপ, মনকাড়া, দৃষ্টিনন্দন। পুরো বাড়িটি ৯ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। মূল বাড়িটি নির্মাণ করেন মহারাজা সূর্যকান্ত। পরবর্তীতে তার দত্তকপুত্র শশীকান্ত প্রাসাদটি পুনর্নিমাণ করেন। কারণ সূর্যকান্তের নির্মিত প্রাসাদটি ভূমিকম্পে আংশিক বা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছিল। শশীলজের মূল ফটকে রয়েছে ১৬টি গম্বুজ। ভেতরে প্রায় প্রতিটি ঘরেই রয়েছে ছাদ থেকে ঝুলন্ত প্রায় একই রকম দেখতে ঝাড়বাতি। সাধারণ বাসভবন ছাড়াও বাড়িটিতে আছে নাচঘর, স্নানঘর। স্নানঘরে রয়েছে একটি সুড়ঙ্গ। ধারণা করা হয়, এই সুড়ঙ্গপথে মুক্তাগাছা যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। মূল ভবনের পেছনভাগেও রয়েছে একটি স্নানঘর। পেছনের স্নানঘরটি দোতলা। এই স্নানঘরে বসে রানী পাশের পুকুরে হাঁসের খেলা দেখতেন। পুকুরটির ঘাট মার্বেল পাথরে বাঁধানো। শশীলজের মূল ভবনের সামনে রয়েছে বাগান। সেই বাগানের মাঝখানে আছে শ্বেতপাথরের ফোয়ারা, যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে গ্রিক দেবী ভেনাসের স্বল্পবসনা স্নানরতা মর্মর মূর্তি। বাগানের ঠিক পেছনেই লালচে ইট আর হলুদ দেয়ালে নির্মিত শশী লজ। এর পাশেই রয়েছে পদ্মবাগান। এই ভবনের পূর্বপ্রান্তে ঘরটি বর্তমানে ব্যবহৃত হয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষের কার্যালয় হিসেবে। শশী লজের অন্দরে বারান্দা অতিক্রম করে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরোলেই রঙ্গালয়। সুদৃশ্য সেই রঙ্গালয়ের এক প্রান্তে বিশ্রামঘর। বিশ্রামঘরের পর কাঠের মেঝেযুক্ত হলঘর। হলঘরের পাশেই বর্ণিল মার্বেল পাথরে নির্মিত আরেকটি জলফোয়ারা। জলফোয়ারার ঠিক ওপরের ছাদ থেকে নিচে ঝোলানো স্ফটিকস্বচ্ছ কাচের ঝাড়বাতি। ভবনটির পেছনে একচিলতে উঠান। সবুজ ঘাসের আঁচল পাতা সেই উঠান পেরোলে একটি অপরিসর জলাশয়। জলাশয়ের পূর্ব ও পশ্চিম পারে দুটি জরাজীর্ণ ঘাট থাকলেও দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দ্বিতল স্নানঘাটটির সৌন্দর্য সত্যিকার অর্থেই অসাধারণ। বাড়িটির আশেপাশে রয়েছে বেশকিছু দুষ্প্রাপ্য ও প্রাচীন গাছগাছালি। আছে দুষ্প্রাপ্য নাগলিঙ্গম, যা তখন হাতির খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আছে পদ্মবাগানও। এই শশীলজেই ধারণ করা হয়েছিল হুমায়ুন আহমেদ রচিত ও পরিচালিত বিখ্যাত ধারাবাহিক নাটক অয়োময়-এর পর্বগুলো, যা বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছিল। নাটকে এটি ছিল জমিদারের বাড়ি। মূলত এই নাটকের পরিচিতির পরেই স্থানীয়দের কাছে বাড়িটি জমিদারবাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়। এছাড়াও রাখাল বন্ধু নামে আরেকটি ধারাবাহিক নাটকের শ্যুটিংও ২০০৩ সালে এই বাড়িটিতে হয়েছিল। এই বাড়ি দেখতেও আলেকজান্ডার ক্যাসেল পর্যটকদের ঢল দেখা যায়। ময়মনসিংহের আইনজীবী শিব্বির আহমেদ লিটন জানান, আলেকজান্ডার ক্যাসেলটিকে দৃষ্টিনন্দন সংস্কার করে লেকটি খনন করলে এটি ময়মনসিংহের একটি পরযটনকেন্দ্র হতে পারত। বিগত দিনে এ বিষয়ে বিস্তারিত লিখে জেলা প্রশাসক বরাবর জনউদ্যোগের পক্ষ থেকে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছিল। আলেকজান্ডার ক্যাসেল দুরবস্থার বিষয়ে আলেকজান্ডার ক্যাসেল দুরবস্থায় সাইনবোর্ড মুছে ফেলা ও লোহারকুঠর বেহাল দশার বিষয়ে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক মো. খলিলুর রহমান জানান, ইতিহাসসমৃদ্ধ সাইনবোর্ডের লেখা ও লোহার কুঠি ভবনটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন