মনোনেশ দাস : মুক্তাগাছায় ইতিহাসের সত্যকে ধারণ করতে গেলে প্রসঙ্গক্রমে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার পরিবারের কথাও উঠে আসে। মুক্তাগাছার রাজ পরিবার ও ভূ-স্বামীদের প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য চৌধুরী ১৭২৭ সালে নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর অনুগ্রহ লাভ করেন। তিনি জমিদারী সদর দফতর বিনোদবাড়িতে স্থাপন করেন।
পলাশীর যুদ্ধের পরপরই আনুমানিক ১৭৬০ সালে শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য চৌধুরীর পর ছেলে রামরাম, হরেরাম, বিষ্ণুরাম ও শিবরাম এ এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
তাদের পূর্ব-পুরুষগণ ছিলেন বগুড়ার অধিবাসী। কথিত আছে, শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য চৌধুরী জমিদারিত্ব নিয়ে এ এলাকায় আসার সময় মুক্তারাম কর্মকার নামের এক দরিদ্র প্রজা পিতলের সুবৃহৎ একটি দ্বীপধার (গাছা) দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান। রাজা খুশি হয়ে এক সময়ের বিনোদবাড়ি মুক্তারামের নামের সঙ্গে প্রদত্ত গাছার সঙ্গতি রেখে এ এলাকার নাম দেন মুক্তাগাছা।
প্রজাদের ওপর জমিদারদের নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনী যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে প্রজাবৎসলের ইতিহাস। জমিদারবাড়ির সামনে দিয়ে জুতো পায়ে ছাতা মাথায় দিয়ে কোনো প্রজা গেলে জমিদাররা পাইক বরকন্দজ দিয়ে তাদের ধরে এনে চাবুক মেরে সাজা দেয়া হত। শাস্তির ভয়ে প্রজারা জুতো, ছাতা বগলে নিয়ে রাজবাড়ির আঙ্গিনা অতিক্রম করত।
পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষিত ও প্রজাবৎসল জমিদারদেরও সংখ্যাও নেহায়েৎ কম ছিল না। শ্রীকৃষ্ণ আচার্য্য চৌধুরীর চার ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে শিবরাম আচার্য্য চৌধুরী বাবার ন্যায় পরম ধার্মিক ছিলেন। তিনি ১৭৭৬ সালে দেশময় খাদ্য সংকটের (মন্বন্তর) সময় মুক্ত হস্তে দান করে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ রক্ষায় এগিয়ে আসেন। খুলে দেন রাজকোষের তালা, খাদ্য ভা-ারের সকল দুয়ার। তার এ মহানুভবতার কথা আজও মানুষের মুখে মুখে গুঞ্জরিত হয়।
নাটোরের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রঘুনন্দন অপু এক বিধায় দত্তক নেন গৌরীকান্তকে। গৌরীকান্তের ছেলে শশীকান্তের সহধর্মীনি রাণী লক্ষীদেবী নিঃসন্তান হওয়ায় ফরিদপুরের মজুমদার বংশের সূর্য্যকান্তকে দত্তক ছেলে রূপে গ্রহণ করেন। এভাবে দত্তকরাই জমিদারী শাসন করে যায় যুগের পর যুগ।
রাণী লক্ষ্মীদেবীর মৃত্যুর পর রাজবংশের জমিদারি চলে যায় কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে। ১৮৬৭ সালে সূর্য্যকান্ত জমিদারি ফিরে পান। পরবর্তীতে এই সূর্য্যকান্তই বৃহত্তর ময়মনসিংহের মহারাজা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি রাজশাহী জেলার কমর গ্রামের শ্রী ভবেন্দ্র নারায়ন চক্রবর্ত্তীর কণ্যা রাজরাজেশ্বরী দেবীকে বিয়ে করেন।
ময়মনসিংহের রাজরাজেশ্বরী ওয়াটার ওয়ার্কাস তারই স্বাক্ষী যুগ যুগ ধরে বহন করে চলেছে। এ জেলায় বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার ইতিহাস এই প্রথম। জমিদার বাড়ির অভ্যন্তরে তার নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তৈরি করেন কারুকার্যময় এক মন্দির। নাম দেন রাজ রাজেশ্বরী মন্দির। জমিদারদের মধ্যে বিবাদ থাকলেও প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান দুর্গা পূজা পালিত হত এই মন্দিরেই। সোনার গহনা দিয়ে জড়ানো হতো প্রতিমা গুলোকে। তৈরি করেছিলেন পাথরের শিব মন্দিরের। রাম কিশোর উচ্চ বিদ্যালয়, নগেন্দ্র নারায়ন বালিকা বিদ্যালয়।
ময়মনসিংহ পৌরসভা হওয়ার অনেক আগেই জমিদারদের উদ্যোগে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের গেজেট নোটিফিকেশন জারির মাধ্যমে মুক্তাগাছা ইউনিয়ন পৌরসভায় রূপান্তরিত হয়।
প্রতিষ্ঠাকালীন পৌর সভায় ছয় জমিদার সূর্য্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরী, অমৃত নারায়ন আচার্য্য চৌধুরী, যোগেন্দ্র নারায়ন আচার্য্য চৌধুরী, কেশব চন্দ্র আচার্য্য চৌধুরী, দূগৃাদাস আচার্য্য চৌধুরী ও কেদার কিশোর আচার্য্য চৌধুরী কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। ময়মনসিংহ পৌরসভা গঠনের আগে মুক্তাগাছা পৌরসভা পতিষ্ঠিত হয়।
১৭৬০ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর এ এলাকায় জমিদারী প্রথা চালু ছিল। ১৯৫৬ সালে তদানীন্তন সরকার জমিদারি প্রথা বাতিল করলে একমাত্র জমিদার বকুল কিশোর আচার্য্য চৌধুরী ব্যতিত অন্যসবাই ভারতে চলে যান। তিনি মৃত্যুর পূর্ব অবধি এখানে অবস্থান করেন।
এখানকার জমিদাররা ছিলেন অত্যন্ত সৌখিন ও শিকারী পাগল। তারা বসবাস ও রাজকার্য পরিচালনার জন্য তৈরি করেন সুউচ্চ একতলা ও দ্বিতল বিশিষ্ট ভবন। ছিল বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা। মধুপুর বনে সদল বলে তাবু গেড়ে তারা শিকার করত বড় বড় বাঘ, হরিণসহ হিংস্র প্রাণী।
জমিদার মহলের সমগ্র আঙ্গিনা ছিল পাকা। হাতি সংগ্রহ ছিল তাদের নেশা। হাতিশালায় মাহুতরা থাকত সদা ব্যস্ত। কে কত বেশী হাতি তাদের হাতিশালায় সংগ্রহ করতে পারে এ নিয়ে চলতো প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা। দুর্গা প্রতিমা বিসর্জনে হত সাজানো হাতির মিছিল। সারা বছর জুড়ে চলত যাত্রা, নাটক, কবি গানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান। দেশের বিখ্যাত শিল্পীদের পাশাপাশি ভারত থেকে আনা হত নামকরা শিল্পীদের। আয়োজন করা হত প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল খেলা। ভারতের বিখ্যাত ক্লাব মোহনবাগান, ইস্ট বেঙ্গল এতে অংশ নিত।
সূর্য্যকান্ত আচার্য্য চৌধুরীর বাড়িটি আজ শহীদস্মৃতি সরকারি কলেজ। ঐতিহাসিক সেই দৃষ্টিনন্দন বাড়িটি পুরনো আদলেই নতুনভাবে সংস্কার করা হয়েছে।
রাজা জগৎ কিশোর আচার্য্য চৌধুরীর বাড়িটি আজও দাঁড়িয়ে আছে কালের স্বাক্ষী হয়ে। দুবৃর্ত্তরা রাতের আধাঁরে বিভিন্ন ভাস্কর্য, কাঠ, লোহাসহ মূল্যবান প্রতœতত্ব সম্পদ লুণ্ঠন করে ফুঁকলা করে দিয়েছে রাজবাড়ি।
মনকাড়া, দৃষ্টিনন্দন, কারুকার্য খচিত ভবনগুলো অযতœ-অবহেলায় আজ বিলুপ্তপ্রায়। এ বাড়ির ঠিক উত্তর পাশেই ছিল রাজা বিষ্ণুরামের বাড়ি। এখানে স্থাপন করা হয়েছে আর্ম পুলিশ ব্যাটালিয়ন। বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল বড় বড় অট্রালিকা। ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২৫ ফুট প্রস্থ্যের একটি ভবন ছাড়া কিছুই আর এখানে অবশিষ্ট নেই। এ ভবনটি এখন ব্যাটালিয়নের অস্রাগার হিসেবে ব্যবহত হচ্ছে।
এ ছাড়াও তারা জনকল্যাণে জেলার বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করেছিলেন জনহিতকর প্রতিষ্ঠান। সেগুলোর মধ্যে ময়মনসিংহ শহরে কালিবাড়ি স্কুল, আলেকজান্ডার ক্যাসেল, মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, এস কে হাসপাতাল, টাউন হলসহ আরও অনেক। আনন্দ মোহন কলেজ বর্তমানে আনন্দ মোহন বিশ্ব বিদ্যালয় কলেজ স্থাপনেও ছিল তাদের উল্ল্যেখযোগ্য অনুদান। প্রজাদের গোসল ও খাবার পানির জন্য খনন করেন শতাধিক বড় বড় পুকুর
সংস্কৃতি কর্মকা-ে অবদান স্মরণযোগ্য। নাটকের জন্য জমিদার জগৎ কিশোর আচার্য্য চৌধুরীর অন্দর মহলের ভিতরে স্থায়ী ভাবে নির্মাণ করা হয় ঘূর্ণিয়মান মঞ্চ। যা ভারত উপমহাদেশে দুটির মধ্যে একটি। পরবর্তীতে তা স্থনান্তরিত হয়ে ময়মনসিংহ টাউন হলে প্রতিস্থাপন করা হয়।
ছিল বাংলার অন্যতম বৃহৎ পাঠাগার, জীতেন্দ্র কিশোর লাইব্রেরি। র্যা গেলের মানচিত্র, বঙ্কিম চট্রপাধ্যায়ের উপন্যাসের প্রথম মুদ্রিত কপি, মীর মোশাররফ হোসেনের রচনার প্রথম মুদ্রিত কপি, রবীন্দ্র ভারতীর অসংখ্য প্রকাশনা, উপ মহাদেশের বিভিন্ন মানচিত্র, হস্তি চিকিৎসা বিষয়ক বই, কীর্তিমানদের আত্ম জীবনী, সংস্কৃত সাহিত্যের গ্রন্থাবলী, ভেষজ চিকিৎসার বই, উদ্যান বিষয়ক গ্রন্থসহ অসংখ্য সংগ্রহ ছিল সেলফে সেলফে ঠাঁসা। ১৯৬৪ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর মূল্যবান বহু গ্রন্থ বেহাত ও নস্ট হয়ে যায়। পরে দশ সহস্রাধিক গ্রন্থ উদ্ধার করে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড ঢাকায় সংরক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে গ্রন্থ গুলো জিতেন্দ্র কিশোর গ্যালারী নামে বাংলা একাডেমীতে সংরক্ষিত রয়েছে।
এ ছাড়াও তাদের বহু মূল্যবান ব্যবহার্য অলংকার, তৈজষপত্র, কাপড় চোপড়, যুদ্ধাস্র, গন্ডারসহ বিভিন্ন পশুর চামড়া, হাতির দাঁতে বুনন শীতল পাটি ও বিভিন্ন উপকরণ বর্তমানে ময়মনসিংহ জাদু ঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
জমিদারদের ফেলে যাওয়া পরিত্যাক্ত সম্পত্তির উপর গড়ে উঠেছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে উপজেলা ভূমি অফিস, নবারুণ বিদ্যানিকেতন, এন এন পাইলট গার্লস হাই স্কুল, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুকুল নিকেতন, কেন্দ্রীয় মসজিদ ও ঈদগাহ্ মাঠসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। জমিদার জামাতাকে উপঢৌকন হিসেবে দেয়া মনোহর কারুকার্যে নির্মিত ভবন। ভবনের মেঝ ও সিঁড়ি মূল্যবান শ্বেত পাথরে ঢাকা। এখানে চলছে উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কার্যক্রম।
প্রজাদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে প্রতিষ্ঠা করেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর, কে, হাই স্কুল। তৎকালে এটিই ছিল স্থানীয় ভাবে একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরে এ বিদ্যালয়টি এতদাঞ্চলে খ্যাতির শীর্ষ স্থান লাভ করে।
জমিদারদের জমিদারি বিলীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বহু বিষয়সম্পত্তি ও কারুকার্যের বাসভবন, মন্দির, নাট মহল, সান বাঁধান ঘাটসহ মূল্যবান স্থাপনাগুলো হয়ে পড়ে জীর্ণ মলিন। ক্ষয়ে ক্ষয়ে হয়েছে কঙ্কাল। ভবনের ইট, সুরকি, আস্তর ধ্বসে পড়েছে। দেয়াল ছাড়াই শুধু খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে জানান দিচ্ছে তাদের অতীত অস্তিত্বের।
কারুকার্য খচিত অট্রালিকা গুলোর মূল্যবান কাঠ, লোহা, পাথরসহ বিভিন্ উপকরণগুলো সুদুর চীন দেশ থেকে আনা হয়। আর তা গড়ার কারিগররাও ছিল সেদেশেরই। তাদের ফেলে যাওয়া কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ভুয়া ও জাল কাগজপত্র প্রস্তুত করে প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় এ ব্যাপারে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও কর্তৃপক্ষ কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
বর্তমানে প্রতœতত্ব অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে নেয়া হয়েছে জমিদারবাড়িসহ রেখে যাওয়া অট্রালিকা, মন্দির ও তৎসংলগ্ন ভূমি। দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক এই জমিদারবাড়ি দর্শনে এসে বিমোহিত না হয়ে পারেন না।
ঐতিহ্যবাহী মুক্তাগাছা জমিদারবাড়িতে সংযুক্ত করা হয়েছে শ্বেত পাথরে লেখা ইতিহাস। বইয়ের পাতার আদলে তৈরি ওই লেখাটি জমিদারবাড়ির সামনে স্থাপন করা হয়েছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন