পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

ময়মনসিংহ অঞ্চলে সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের একাল সেকাল


 মনোনেশ দাস : সাংবাদিক হওয়ার জন্য আমাকে কেও অনুপ্রাণিত করেনি । মফস্বলে সাংবাদিকতা একটি জীবনব্যাপী শিক্ষা মনে করি । চারণ সাংবাদিক আখ্যা দিয়ে সম্প্রতি সংবাদপত্রে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাকে নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে । আমাকে যারা চেনেন বা জানেন তাদের কাছে ভাল লাগলেও অনেকে আশ্চর্য হয়েছেন । অনেকে জানার আগ্রহ প্রকাশ করছেন, কে এই চারণ সাংবাদিক মনোনেশ দাস । আসলে আমি সাংবাদিকতায় একদিনে গড়ে উঠিনি । অনেক সময়, অধ্যাবসায়, মেধা, শ্রম, ধৈর্য্যসহ অনেক মূল্য দিতে হয়েছে । লেটার প্রেসের যুগে সাংবাদিকতায় এসেছি । ক্রমান্বয়ে ফ্যাক্স, কম্পিউটার, ইমেইল এসেছে । খোলা খামে হাতে লেখা পাঠানো সংবাদ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে কয়েকদিন বা এক সপ্তাহ পাড় হলে। মানুষের সচেতনতায় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, কুসংস্কার , অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ধর্ম, গোত্র, সম্প্রদায়, ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষি, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ, প্রকৃতি, পরিবেশ, কীট- পতঙ্গ, গাছ- পালা, মাটি, পানি থেকে শুরু করে যা দেখেছি তাই লিখার চেষ্টা করেছি । আমি জানিনা সেগুলো আসলেই সংবাদ কি না ! আমার অধিকাংশ লেখা প্রকাশ হয়েছে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত দৈনিক জাহান পত্রিকায় । যা অনলাইনে সংরক্ষিত নেই । বর্তমান অনলাইন যুগে ও সংবাদ লেখার ধারাবাহিকতায় নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছি এটাও একটি চ্যালেঞ্জ ছিল আমার। গুগলের বদৌলতে সার্চ ইঞ্জিনে আমার অনেক লেখাই ভেসে আসে মানুষের চোখের সামনে । বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, সামহোয়ারইন ব্লগ, ঢাকা টাইমসে অনেক লেখা আছে,যেখানে আমাকে সিটিজেন জার্নালিস্ট বলা হয়েছে । মূলত যারা আমার এসব লেখা উপলব্ধি করতে পারছেন তারাই আমাকে নিয়ে লিখছেন । অগ্রজ চারণ সাংবাদিক মোনাতাজ উদ্দিন ভাই লিখে গেছেন । স্মৃতি হয়ে থাকবেন অনন্তকাল । জীবমানে তিনি যে স্বীকৃতি পেয়েছেন মৃত্যুর পর আরো বেশি মূল্যায়িত হয়েছেন তিনি । আমার অনেক লেখা আছে যা ইন্টারনেটের প্রযুক্তির কাছে পৌছায়নি । হয়তো একদিন সেগুলোও আবিষ্কৃত হবে । 


বর্তমান প্রজন্ম চাহিদার সংবাদটি গুগলে অথবা ফেসবুক না দেখলে আনইনর্ফর্মড হই এমন কথা বলেন, আর দেখলে মিস ইনফর্মড। আমাদের বিরুদ্ধেও মানুষের উষ্মার প্রকাশ দেখি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও । আসলে, আমরা যা জানি না তা যদি অকপটে স্বীকার করি যে, আমরা জানি না, তা হলে বোধহয় সমস্যাটা অনেক কম হয়। রাজনৈতিক সংবাদের চিত্রই ধরা যাক । বস্তুত আমি থাকি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় অথবা ময়মনসিংহ সিটিতে। সারাদেশের খবর রাখি কি করে ? সতের আঠারো কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। মুক্তাগাছা বা ময়মনসিংহ শহরে সারা দিন কাদের সঙ্গে কথা বলি ? অর্থাৎ, আমার সংবাদের সূত্র কী ? আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দলের নানা স্তরের নেতা, বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, ডিসি, এসপি, ইউএনও, ওসি , সরকারি - বেসরকারি চাকুরীজীবি, চিকিৎসক, আইনজীবি, শিক্ষক, গবেষক, সহকর্মী সাংবাদিক, পত্রিকার এডিটরসহ অনেকেই। যদি এই শহরে আসা-যাওয়ার পথে কোনও চা বিক্রেতা অথবা ড্রাইভার, শিল্পি বা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা হয় তা হলেই ভাবি মরুভূমির ধূলিকনায় বেড়ে ওঠা গাছ-পালা, কীট-পতঙ্গ , ক্ষুদ্র প্রাণি এমনকি খারমান এর মত মত উদ্ভিদ দর্শন হয়ে যায়। কিন্তু আমার মত সেখানকার একজন অধিবাসী প্রান্তিক, তিনি কতটা গরীব, কতটা ধনী কি ? ভাবি আমার চেয়ে তিনি ধনী আবার অনেক চেয়ে গরীব। গরীব তাকে ভোট দেয়া যাবে না । আবার অমুক দল ক্ষমতায় গেলে ভাল করছে । তমুক দল দেশ ডুবিয়েছে । আবার প্রজাতিকূলে অদ্ভুত প্রকৃতির আকারের ও বর্ণের আবির্ভাব ঘটে । বিজ্ঞানীরা এই ধরনের পরিবর্তনের কারণ হিসাবে প্রজাতির জেনেটিক্যাল বৈশিষ্টে সেগ্রিগেশন বা জ্বীনের ব্যতিক্রমধর্মী আচরণকে ফেনোটাইপ দায়ী করেন । সাধারণত গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে উদ্ভাবিত ধান বা শষ্যাদিতে এ ধরণের সেগ্রিগেশন হরহামেশা দেখা যায় । কিন্তু প্রকৃতিতে সেগ্রিগেশন খারমান । অর্থাৎ আগন্তুক এসেছে নেতা হয়ে খুবই বিরল ।


রাজনীতির মত আরো যে কত সংবাদ পড়ে আছে । যা আবিষ্কার করেন আমার মত সাংবাদিকরাই । বিশ^বিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতার পাঠ চুকিয়ে কেও অফিসে, আবার কেও মাঠে কোন একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন । আমাদের ত সকল বিষয় নিয়েই লিখতে হয় । মফস্বলে থেকে আমার লেখাও গোটা বাংলাদেশে ঝড় তুলে । মুক্তাগাছা থেকে দৈনিক ইত্তেফাকে সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করি । এখানে থেকেও কর্মক্ষেত্রের ব্যাসার্ধ থেকে ছিটকে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, চট্রগ্রাম, রংপুর, সিলেট, ঢাকা যাওয়ার সময় পাই না। 

ছোটবেলায় দেখেছি, বাড়িতে আসা ডাক্তাররা নাড়ি টিপতেন । নাড়ি টিপে , চোখ, মুখ, জিহবা দেখে রোগ নির্ণয় করতেন । জ¦র হলে ম্যালেরিয়া না ফাইলেরিয়া থেকে হচ্ছে তা বোঝার জন্য সোনোগ্রাফি করতে বলতেন না। এখন তা না। ব্লাড , সুগারটেস্ট আরো কত টেস্টের রিপোর্ট দেখে ওষুধের প্রেসক্রিপশন দেন বর্তমানের ডাক্তার। মফস্বল সাংবাদিকদেরও অভিজ্ঞতা বেড়েছে । মুক্তাগাছায় সাংবাদিকতা শুরু করে বেসরকারি টেলিভিশনের ময়মনসিংহ প্রতিনিধি , একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক , ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের সদস্য ও ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছেন আবু সালেহ মো: মুসা।যিনি আমাকে দুই যুগ আগে থেকেই আমাকে চারণ সাংবাদিক আখ্যায়িত করে আসছেন। আবার এখানকার মানুষরা রাজধানীতে বসে সাংবাদিকতা করলেও নিজের মফস্বলের কোন বিষয় নিয়ে তেমন একটা লিখেন না ।

বাংলাদেশে মফস্বল এলাকায় সাংবাদিকদের সংগঠন প্রেসক্লাব গঠনের আগে চারণ ভূমিতে ঘুরে বেড়িয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতেন । মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করতেন। এমন প্রেসক্লাবগুলি শক্তিশালী হওয়ায় ভিত শক্ত হয়েছে । মফস্বলে সাংবাদিকতায় বিজ্ঞানও আছে । এই বিজ্ঞানে সমীক্ষা একটা খুব কঠিন কাজ। মফস্বলের অধিকাংশ সাংবাদিক অপেশাদার এমনটা না হলেও বিপুল জনসংখ্যার দেশে ঠিক ঠিক মতামত পেতে গেলে সাংবাদিককে ব্যক্তিগতভাবে অনেক টাকা-পয়সা খরচ করা দরকার। মফস্বলের মানুষকে সব সময় বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই। অনেক সময় সত্য গোপন করেন দুর্নীতিবাজরা। এরা, উল্টো কথাও বলেন। 


অঙ্ক শাস্ত্রে কিউব স্কয়ারের চাইতে যেমন উপরে তেমনি দুই আর দুই চার সবাই বুঝি। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে যেখানে বিচার্য বিষয় মানুষের আচরণ সেটা সবটাই বস্তুগত নয় । দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষের বিরুদ্ধে মানুষের যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে সংবাদপত্রের পাতায় তা সীমাবদ্ধ । আমরা অর্থাৎ মফস্বলের সাংবাদিকরা চেষ্টা করছি এসব লিখার পরিসর বৃদ্ধিতে ।

পৃথিবীতে এখন অনলাইন গণমাধ্যমের জয়জয়কার । বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই । ময়মনসিংহে এর ভিন্নতা এখনও লক্ষ করা যায় । ময়মনসিংহ থেকে ময়মনসিংহ বার্তা , ময়মনসিংহ নিউজ নামের দু’টি অনলাইন পত্রিকা প্রকাশ হয় । অপরদিকে প্রিন্ট পত্রিকা দৈনিক জাহান , আজকের খবর, আজকের বাংলাদেশ, দৈনিক স্বজন, দৈনিক মাটি ও মানুষ, আজকের ময়মনসিংহ, দৈনিক স্বদেশ সংবাদ, দৈনিক দিগন্ত বাংলা, দৈনিক কালের আলো, দৈনিক লোকলোকান্তর, জনতার কণ্ঠস্বর, দৈনিক হৃদয়ের বাণী, দৈনিক দেশের খবরসহ আরো অনেক দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় । এই স্থানীয় পত্রিকাগুলির পাঠক ময়মনসিংহ কেন্দ্রিক । অপরদিকে অনলাইন পত্রিকার পাঠক কেবল ময়মনসিংহে সীমাবদ্ধ নয় । সারা বিশ্বে ।


বাংলাদেশের শীর্ষ পত্রিকা, ইত্তেফাক, প্রথম আলো, যুগান্তর, কালের কন্ঠ, সমকাল, জনকণ্ঠসহ ঢাকা থেকে কমপক্ষে ৫০টি প্রিন্ট পত্রিকা ময়মনসিংহে আসে । প্রিন্ট পত্রিকাগুলিতে পুরনো খবরের সম্ভার । তার পরও মানুষ কেন পড়ে তা বুঝতে বেশী কষ্ট হয় না । আমাদের ময়মনসিংহের পাঠকরা এখনও ইন্টারনেট প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হননি । অবসরপ্রাপ্ত লোকদের নির্ভর প্রিন্ট পত্রিকা । স্থানীয় প্রিন্ট পত্রিকাগুলির যে সুদিন তাও নয় , তাদের মূল আয় কিছু বিজ্ঞাপন । আবার বড় আয় রিপোর্ট । কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মনগড়া রিপোর্ট প্রকাশ করে প্রতিবাদ ছাপিয়ে ভালো আয় হয় । এই আয় না হলে স্টাফদের খরচ উঠানো দু:সাধ্য হয়ে পড়ে ।


একটি প্রিন্ট পত্রিকার সাথে জড়িত স্টাফের সংখ্যা নেহায়েত কম নয় । কম করে হলেও ৫/৭ জন তারও বেশী । পক্ষান্তরে অনলাইন পত্রিকার স্টাফ ২/১ জন । আপডেট দেয়ার একজন আর সম্পাদক । তারপরও অনলাইন পত্রিকা কর্তৃপক্ষ ভালো চলতে পারেন না । কারো বিরুদ্ধে রিপোর্ট প্রকাশ হলে প্রতিবাদ প্রকাশ হয়েছে এমন ঘটনা ঘটেনি । অনলাইন পত্রিকাকে ময়মনসিংহে নেহায়েৎ হাসি তামাশার পত্রিকা বলে মনে করে থাকেন । এর জন্য প্রিন্ট পত্রিকা ওয়ালারাই দায়ী বলে মনে করা হয় । এমন ঘটনাও ঘটেছে , অনলাইন পত্রিকার খবর প্রিন্ট পত্রিকায় প্রতিবাদ ছাপানো হয়েছে । আমি ময়মনসিংহ বার্তার সম্পাদক । দুই বছর পার হয়েছে পত্রিকা প্রকাশের । আজো একটি টাকা কামাই হয়নি পত্রিকা থেকে । যদিও নেশায় পত্রিকাটি চালাই । স্টাফ নেই । নিজেই আপডেট দেই । মাঝে মধ্যে সময়ের অভাবে যখন আপডেট বন্ধ করলে সাংবাদিকদের ফোন আর ফোন । তারপরও প্রত্রিকা চালিয়ে যাচ্ছি । পৃথিবীর বহু দেশে প্রিন্ট ত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে । তারা চালু করেছে অনলাইন । বাংলাদেশের প্রিন্ট পত্রিকাগুলি অনলাইন ভার্সন চালু করেছে । তখন মনে হয় অবশ্যই একদিন আমার ভ্যাগ্য খুলবে । সেই প্রতিক্ষায় ।


পত্রিকার নাম, সম্পাদক , প্রকাশের স্থানকাল যাই হোক না কেন তাঁদের ব্রত একটাই- কল্যাণকর আগামি । পত্রিকা প্রকাশের কত শত বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু প্রকাশ যন্ত্রণার মৌল প্রেরণা এখন অবিনাশি আনন্দময় সুখের উপমা । পত্রিকার নামটা বদলে যায়, তরুণদের চেহারাটা হয়তো ভিন্ন হয় কিন্তু থাকে হুবহু এক । হাজার বছর আগে অথবা পরে । ১৮৬৫ সালে ময়মনসিংহ থেকে (শেরপুর) ‘বিদ্যোন্নতি সাধিনী’ নামে মাসিক পত্রিকা বেরুত । শ্রীনাথ চন্দ্রের সম্পাদনায় ‘বাঙ্গালি’ নামে মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো ময়মনসিংহ শহর থেকে । এই শ্রীনাথ চন্দ্র ময়মনসিংহের সাহিত্য সংস্কৃতিতে প্রাণের জোয়ার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । বর্তমান সময়ের সার্বক্ষণিক সাহিত্য কর্মীদের মতো ধূসর দূর অতীতে ছিলেন শ্রীনাথ চন্দ ।


টাঙ্গাইলের ফুলবাড়ীতে জন্মগ্রহনকারী শ্রীনাথ চন্দ (১৮৫১- ১৯৩৮) ময়মনসিংহ ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম সংগঠক ছিলেন । বিদ্যাময়ী স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শ্রীনাথ চন্দ আনন্দ মোহন কলেজ স্থাপনেও প্রভূত সহায়তা করেছিলেন । ১৮৭৫ সালে প্রকাশিত হতো ‘প্রমোদী’ ‘সুহৃদ’ ‘ভারত মিহির ’ ইত্যাদি পত্রিকা । মুক্তাগাছায় প্রকাশিত হতো ‘প্রমোদী’ মাসিক পত্রিকা । । বাংলা ১২৮২ সালের আশ্বিন মাসে এই পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল । সুহৃদ সাপ্তাহিক পত্রিকাও মুক্তাগাছায় প্রকাশিত হতো । ১২৮২ সালের ১লা বৈশাখ পত্রিকাটির ১ম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিলো । প্রথম প্রকাশের ১২৩ বছর পর ঐতিহ্যের স্মারক চিহ্ন বুকে ধারণ করে ‘সুহৃদ ’ দ্বিতীয়বার প্রকাশিত হয় ১৪০৫ বঙ্গাব্দের ২রা পৌষ মুক্তাগাছা পৌর সাধারণ পাঠাগার থেকে । অনাথবন্ধু গুহের সম্পাদনায় ময়মনসিংহ শহর থেকে প্রকাশিত হতো ‘ভারত মিহির’ । জানকীনাথ ঘটক, শ্রীনাথ চন্দ, আনন্দ চন্দ্র মিত্র , কবি দীনেশচরণ বসু, অমরচন্দ্র দত্ত প্রমুখ এই পত্রিকার নিয়মিত লেখকই শুধু ছিলেন না , নানা জনহিতকর কাজের সাথেও এই লেখকগোষ্ঠি ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন ।

১৮৭৬ সালে আমরা সাপ্তাহিক ‘বিশ্ব সুহৃদ’ পত্রিকার খোঁজ পাই । এটি ময়মনসিংহ শহর থেকেই প্রকাশিত হতো । ময়মনসিংহের সুসঙ্গ দুর্গাপুর থেকে প্রকাশিত হতো ‘ কৌমুদী’ পত্রিকা । ১৮৭৮ সালে এই পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন রুক্সিনীকান্ত ঠাকুর । রুক্সিনীকান্ত ঠাকুর ছিলেন পত্রিকা- পাগল মানুষ । তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত ছিল পত্রিকা সংগঠন, পত্রিকা প্রকাশনা ইত্যাদি । দুর্গাপুরের মহারাজা শিবকৃষ্ণ সিংহ এর মালিকানায় ‘আর্যপ্রভা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৮৮০ ইং সালে । এই পত্রিকারও সম্পাদক ছিলেন রুক্সিনীকান্ত ঠাকুর । ১৮৮১ সালের উল্লেযোগ্য দু’টি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ সুধারকর ’এবং চারুবার্তা’ । প্রথমটি ময়মনসিংহ শহর ও দ্বিতীয়টি শেরপুর শহর থেকে প্রকাশিত হতো ।


চারুবার্তার অন্যমত প্রধান লেখক কবি দীনেশ চরণ বসু ময়মনসিংহ সভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন । তাঁর উল্লেখযোগ্য কব্য গ্রন্থ : মানস বিকাশ , কবি কামিনী , মহা প্রস্থান ইত্যাদি । ‘ বাসন্তী ’ ছিল মাসিক পত্রিকা । ময়মনসিংহ শহর এর সূতিকাগার । সম্পাদনা করতেন ব্রজনাথ গঙ্গোপাধ্যায় । ‘উদ্দেশ্য মহৎ’ ১৮৮৮ সালে ময়মনসিংহ শহরের পত্রিকা । ময়মনসিংহ সাহিত্য সভার মুখপাত্র হিসাবে প্রকাশিত হতো মাসিক ‘আরতি’ । এটি ১৯০১ সালের পত্রিকা । ১৯০৩ সালে এম. এস নূরুল হোসেন কাশিমপুরী সম্পাদনা করতেন ময়মনসিংহ শহরের মাসিক ‘হানিফি’ । বিশ শতকের শুরুও দশকে কেদারনাথ মজুমদার লেখালেখি , গবেষণা , পত্রিকা প্রকাশ, পুস্তক প্রকানা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ময়মনসিংহবাসীর সামনে যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন সেটি আজো আলোকবর্তিকা হিসাবে কাজ করছে ।


তাঁর সম্পাদিত ‘সৌরভ’ পত্রিকা , চন্দ্রকুমার দে প্রসঙ্গ , দীনেশ চন্দ্র সেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় , দুশন জবাভিতেল এইসব মহত্তম ঘটনার স্মারক গৌরবে ‘মৈমনসিংহ – গীতিকা ’ আজ বিশ্ববাসীর গৌরব মহিমায় অভিষিক্ত । চিরকালে মানব মহিমার এই যে চির ভাষ্কর মনোভূমির যুগোত্তীর্ণ রত্ন সম্পদ ‘মৈমনসিংহ- গীতিকা’ – তার পেছনে পত্রিকার ভূমিকা ছিল অনুপম জননীর মতো । মমতার আদরে , দায়িত্বেও শৃঙ্খলে পত্রিকাগুলো মানুষ তৈরীতে, মূল্যবোধে সৃজনে পালন করেছে যথার্থ অভিভাবকের ভূমিকা । এসব মানুষগুলোই যুগে যুগে সুনীতির পক্ষে দাঁড়িয়েছে । সমাজে শুভবোধের প্রতিষ্ঠা করেছে ।

১৯১৩ সালে ‘সৌরভ’ পত্রিকায় চন্দ্রকুমার দে প্রাচীন মহিলা কবি চন্দ্রাবতীকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছিলেন । সৌরভ সম্পাদক কেদার নাথ মজুমদার ছিলেন দীনেশ চন্দ্র সেনের পুরনো বন্ধু । দীনেশ চন্দ্র সেনের গভীর আগ্রহে চন্দ্র কুমার দে স্ত্রীর সঞ্চিত সামান্য রুপায় গয়না বিক্রি করে পাথেয় জোগাড় করে ১৯১৯ সালের দুর্গাপূজার আগে দীনেশ চন্দ্র সেনের সাথে দেখা করলেন । লিখেছেন দীনেশ চন্দ্র- “রোগে - দুঃখে জীর্ণ , মুখ পান্ডুরবর্ণ , অর্দ্ধাশনে -অনশনে বিশীর্ণ , ত্রিশ বছর বয়স্ক যুবক, অতি অল্পভাষী , তিনি পল্লী জীবনের যে কাহিনী শুনাইলেন ও মৈমনসিংহের অনাবিস্কৃত পল্লীগাথার যে সন্ধান আমাকে দিলেণ, তাহাতে কখনই তাঁহাকে আমার প্রিয় থেকে প্রিয়তর বলিয়া মনে হইল । ’

অতঃপর অনেক ত্যাগ কষ্ট সর্বোপরি জীবন বিপন্ন করে মৈমনসিংহ গীতিকার গাথাগুলি কিভাবে সংগৃহিত হয়েছিল সে কাহিনী কম বেশী সবারই জানা । যেটি আমরা অনেকেই জানিনা , তা হলো মৈমনসিংহ গীতিকা সংগ্রহ পরবর্তী সময়ে প্রকাশের জন্য কি দুঃসহ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হয়েছিল । ময়মনসিংহবাসীরা সে সময়ে কোলকাতায় একটি সভা আহবান করে । সভায় তাঁরা জানতে চান গাথাগুলি ব্যাপারে তাদের করণীয় কি ? শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন , রায় বাহাদুর , বিএ,ডি.লিট . দীর্ঘ বক্তৃতা করেন এবং কাজ চালাবার মতো মাত্র দশ হাজার টাকা সভার কাছে চান । সভার সভাপি ছিলেন সন্তোষের রাজা শ্রীযুক্ত মন্মথনাথ রায় চৌধুরী । সভায় আশ্বাস দেয়া হয়েছিল শ্রীঘ্রই টাকার ব্যবস্থা করা হবে । বাস্তবে কিছুই করা হয়নি ।

ঐতিহ্য -বিস্মৃত জাতি হিসাবে আমাদের সুনাম বহুকালের । রোগে , শোকে , বিদীর্ণ মৃত্যুপথযাত্রী দীনেশ সেন লিখেছিলেন, ‘ ঝুলি কাঁধে করিয়া দুয়ারে দুয়ারে বাহির না হইলে ভিক্ষা জোটে না । আমি রোগের দরুণ বিছানায় পড়িয়া আছি , আমি ভিক্ষুক সাজিয়া বড় মানুষের বাড়ীতে যাইয়া হাত পাতিতে অক্ষম । বিশেষতঃ আমি মৈমনসিংবাসীগণের নিকট ভিক্ষা চাহিতে লজ্জা বোধ করি , সেখানে কি আমার কোন দাবীই নাই ? ’ সাহিত্য পত্রিকা আমাদের ঐতিহ্যের গহন গভীরে নিয়ে যাক যেখানে সভ্যতার শেকড় প্রোথিত । ঐতিহ্যের দায়ভার কাউকে না কাউকে গ্রহণ করতেই হয় । সময় মহিমার অশ্রু- ঘামে সাহিত্য সাধক কিংবা পত্রিকা সম্পাদক জীবন পুড়িয়ে লেখা সংগ্রহ করেন , পৌঁছে দেন উত্তর প্রজন্মের হাতে ।
এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত ত্রিশালে ময়মনসিংহ ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনের উদ্যোগে ত্রিশাল রিপোর্টার্স ক্লাবে লেখককে চারণ সাংবাদিক ও নাগরিক সাংবাদিক হিসাবে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছে । সংবর্ধনা পেয়ে আনন্দিত, উৎসাহিত , পুলকিত, উল্লসিত , গর্বিত ও ধন্য মনে করি । চালন সাংবাদিকতার প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে উৎদীপ্ত করবে বলে মনি করি।
সূত্র: বিডি নিউজ ২৪, মুক্তাগাছা নিউজ ব্লগস্পোট ডটকম ও অনলাইন গণমাধ্যম ।
লেখক, গণমাধ্যম কর্মী ও ব্লগার 
মোবাইল, ০১৭১২৮৫৬৯৯৫


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন